বঙ্গ-নিউজ: শ্যামা সংগীত ও কাজী নজরুল ইসলাম-৬
১৩৪৭ বঙ্গাব্দের ২৯ শে কার্ত্তিক, ইংরেজী ১৯৪০ সালের ১৫ ই নভেম্বর, সন্ধ্যায় কাজী নজরুল ইসলাম এলেন লালগোলায়। যোগীবর বরদাচরণ তখন অন্তিম শয্যায় শায়িত। সেখানেই শেষ মিলন হল গুরু-শিষ্যের। এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী নিশেষ ভূষণ সান্যাল মশায় এই শেষ দৃশ্য বর্ণনা করেছেন-“ কাজী সাহেব রোগীর দরজার বাহির থেকেই অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে ‘দাদা’ সম্বোধন করে একেবারে যোগীরাজের শেষ শয্যায় গিয়ে বসে পড়েছিলেন। তার প্রতিটি কথার মধ্যে থেকে ভেসে আসছিল একটা অন্তরমথিত করা চাপা ক্রন্দনের রেশ। অত্যন্ত স্নেহপূর্ণ স্বরে যোগীরাজ ডেকেছিলেন,” কাজী ভায়া”। দুজনেই দুজনের পানে চেয়েছিলেন। দৃষ্টি দ্বারেই হয়েছিল পরস্পরের হৃদয় বিনিময়। শিবকল্প গুরুর সাথে হয়েছিল অন্তরঙ্গ অনুগত শিষ্যের মিলন। সে কি মহিমাময় দৃশ্য।
কিছুটা শান্ত কাজী সাহেব সহসা যোগীরাজের সম্মুখে মাটির উপর পা ছড়িয়ে বসে পড়েছিলেন, রোগীর দিকেই পা দুখানি প্রসারিত। আরম্ভ করেছিলেন এক যৌগিক মুদ্রা, সেই সঙ্গে সঙ্গে উচ্চৈঃস্বরে “ হুঁ মা” মন্ত্রোচ্চারণ। এই প্রক্রিয়া প্রায় ৪/৫ ঘন্টা একই নাগাড়ে চলার পর মাত্র এক পেয়ালা চা খেয়েই গিয়েছিলেন বিশ্রাম করতে।
সে কালরাত্রিটাও যথারীতি অবসান হয়েছিল। দেখা দিয়েছিল নতুন দিনের নতুন রবি পূবের আকাশে। প্রাতঃস্নান সেরে কাজী সাহেব রোগীর ঘরেই ধ্যানে বসেছিলেন। তারপর সঙ্গীত। জীবনের অচ্যুত সারথীর প্রিয় সঙ্গীত গুলো একটার পর একটা। সবশেষে শ্রীগুরুর শেষ আদেশ “ কাজী ভায়া”। এবার শেষ গান “শ্মশানে জাগিছে শ্যামা।”
নিজেকে ধরে রাখা কাজী সাহেবের পক্ষে আর সম্ভব হয়নি। আকুল কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন কিছুক্ষণ কথা বলতেই পারেননি। তারপর অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করার ব্যর্থ চেষ্টার পর বলেছিলেন-‘দাদা, স্বধামের কথা কী আজ সত্যিই মনে পড়ছে? আমাদের কী সত্যিই ছেড়ে যাবেন?’ স্নেহঝরা কন্ঠে যোগীরাজ বলেছিলেন, ‘কাজী! ভাই! শিক্ষা দিতে তো কার্পণ্য করিনি। তবে এ দুর্বলতা কেন?’ কাজী ভাই তদুত্তরে বলেছিলেন-‘ দাদা! বুঝি সবই কিন্তু স্নায়ুগুলো যে ছিঁড়ে যাচ্ছে দাদা। অতিকষ্টে অত্যন্ত দরদ দিয়ে তাঁর জীবন-রথের সারথীকে তাঁর অতি প্রিয় গান শুনিয়ে শ্রীগুরুর অন্তিম ইচ্ছা পূরণ করেছিলেন। মরজীবনে এই তাঁর শেষ গান শোনা।”১৭
সেই দিনই( ৩০ শে কার্ত্তিক) রাতের গাড়িতে বিদায় নিয়েছিলেন কবি এবং ঠিক তাঁর পরের দিন প্রাতেই অর্থাৎ ১৩৪৭ বঙ্গাব্দের ১-লা অগ্রহায়ণ প্রয়াত হন বরদাবাবু।১৮
বরদা বাবুর প্রয়াণের পর মাত্র দেড় থেকে দুই বছর সুস্থ এবং সবাক ছিলেন কাজী নজরুল .১৯৪২ সালে তাঁর শেষ দিকের লেখা শিক্ষা কবিতার শেষ চরণে কবি লিখছেন-“ সমাধি হইতে আর যেন নাহি উঠি প্রলয়ের আগে।” হয়ত তারপরেই তিনি সমাধিতে চলে গেলেন।১৯
তথ্যসূত্রঃ
১১। পাল ছবিলাল।৩১ শে আগস্ট, ভালমন্দ পত্রিকা। সাধক নজরুল।
১২। মজুমদার বরদাচরন । পথ হারার পথ।
১৩।পাল ছবিলাল। ৩১ শে আগস্ট ,ভালমন্দ পত্রিকা। সাধক নজরুল।
১৪। রায় অমরনাথ। যোগীবর বরদাচরণ।করুণা প্রকাশনী। কলকাতা৯
১৫।পাল ছবিলাল। ভালমন্দ পত্রিকা।সাধক নজরুল।
১৬। রায় অমরনাথ। যোগীবর বরদাচরণ। করুণা প্রকাশনী। কলকাতা৯
১৭।ঐ
১৮।ঐ
১৯।পাল ছবিলাল। ৩১ শে আগস্ট ,ভালমন্দ পত্রিকা।
*মূল প্রবন্ধটি “মুর্শিদাবাদ অনুসন্ধান: দ্বিতীয় খণ্ড” গ্রন্থে আছে*
তথ্য ঋণ-
Padakkhep patrika chinsurah, dt- May 26,2019
( পদক্ষেপ পত্রিকা, চূঁচুড়া)
বরদা চরণ ও কাজী নজরুল ইসলাম
সুমন কুমার মিত্র।
( চলবে )