বঙ্গ-নিউজ: শ্যামা সংগীত ও কাজী নজরুল ইসলাম-৪
সাকার মুস্তাফা তাঁর বইটির মুখবন্ধে লিখেছেন, নজরুল অসাম্প্রদায়িকতার পরিপূরক নাম। আজকের এই অসহনীয়তার যুগে নজরুলের পরধর্ম সহনীয় মনোভাব বড় বেশী দরকার । সে জন্য প্রয়োজন নজরুলের বহুমুখী চর্চার। শ্যামা সঙ্গীত রচনা এবং ভক্তিরসের মধ্য দিয়ে অন্যের ধর্মকে তিনি যে ভাবে সম্মান দেখিয়েছেন , তার কিছু অংশ থাকলেও আজ এই রক্তারক্তি হতো না।
তিনি লিখেছেন, নজরুল বিষয়ে প্রচুর গবেষণা হয়েছে, হয়তো ভবিষ্যতে আরও হবে। এই লেখালেখি শুরু হয়েছে প্রধানত তাঁর নির্বাক ( ১৯৪২ পরবর্তী সাল ) হয়ে যাবার পর থেকে । তবে এর আগেও নজরুল-সাহিত্যের বিস্তর প্রসংশা-নিন্দা শুরু হয়েছিল। তর্ক-বিতর্কের কেন্দ্র বিন্দু হয়েছিল – তা নজরুল পাঠক মাত্রই জানেন। কিন্তু শ্যামা সঙ্গীতের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ প্রায় সময় অনালোকিত থেকে গেছে। শুধু শ্যামা সঙ্গীত কিছু আলোচনা হলেও তিনি শ্যামা সাধক ছিলেন কিনা ,সে বিষয়ে বিস্তারিত কোনো আলাপ পাওয়া যায় না। যেটুকু আলোচনা কেউ কেউ করেছেন সে সকল লেখকের মধ্যে দু’টো ধারা লক্ষ করা যায়। প্রথমত, মুসলমান-নজরুল-গবেষকদের মধ্যে দু’একজন বিষয়টি উল্লেখ মাত্র করলেও নজরুলের কালী সাধনার বিষয়ে কোনো আলাপই করেননি। বোঝা যায় ব্যাপারটি এড়িয়ে গেছেন, কেউ কেউ তো- কোন বাক্যই লেখেননি এ ব্যাপারে। আর কিছু গবেষকের মধ্যে কেউ কেউ বিষয়টি উল্লেখ করেছেন , কেউ আবার কালী সাধনা শব্দটি প্রয়োগ না করে যোগসাধনা . আধ্যাত্মিকতা বলতে স্বস্তি বোধ করেছেন।
দ্বিতীয়ত,দু’একজন গবেষক অতি উচ্ছাসের জায়গায় থেকে বিষয়টি আলোচনা করেছেন। ফলে সেখানেও নানা ধরনের ধর্মীয় প্রীতি জনিত অতিরঞ্জন ভর করেছে। কিন্তু এ সব আরোচনার মধ্যে থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট , তিনি পুত্রশোক এবং স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে দিনে দিনে এতই নিরুপায় হয়ে উঠেছিলেন যে, একটু শান্তি আর মুক্তির জন্য একটা পথ তীব্র ভাবে খুঁজছিলেন। সেই পথ কি? শ্যামসাধনায় তিনি দীক্ষা নিয়েছিলেন অথবা তিনি যোগসাধনা করতেন। যাঁরা দীক্ষা নেয়াটাকে অস্বীকার করেছেন, তাঁরাও কেউ কেউ যোগসাধনার ব্যাপারটি স্বীকার করেছেন।
নজরুল কালী সাধনায় দীক্ষা নিয়ে ছিলেন কিনা সে সম্পর্কে কয়েকটি মত বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে।
১. ১৯৩০ সালের মে মাসে নজরুল পুত্র বুলবুল বসন্ত রোগে মারা যায়।…..পুত্র শোক ভোলার জন্য সে তখন অনেক চেষ্টা করেছেন। কবি জসিম উদ্দীন লিখেছেন., তিনি তখন নজরুলকে একদিন খুঁজে পেলেন ডি এম লাইব্রেরীর দোকান ঘরের একটি কোনে। পুত্রশোক ভুলার জন্য সে সেখানে বসে বসে হাসির কবিতা লিখছিল এবং কেঁদে কেঁদে নিজের চোখ ফুলিয়ে ফেলছিল। এত করেও নজরুল বাঁচতে পারলো না, শোকাতুর পিতার মানসে যে দুর্বলতা প্রবেশ করেছিল তার নিকট সে ধরা দিল। সে গেল লালগোলা হাইস্কুলে হেডমাস্টার শ্রীযুক্ত বরদাচরণ মজুমদারের নিকটে। ( মুজফ্ফর, ২০০৬,২৪৩)
২. সব চিকিৎসা ব্যর্থ হওয়ায় পর একদিন গিরিবালা দেবীকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এখন কি আর তার ( প্রমীলার ) কোনো চিকিৎসা হচ্ছে না ? তিনি বললেন, লালগোলা হাইস্কুলের হেডমাস্টারশ্রী বরদা চরণ মজুমদার এখন হোমিও প্যাথিক ঔষধ দিচ্ছেন। তারই নিকটে নজরুল দীক্ষা নিয়েছেন। ( মুজাফ্ফর ,২০০৬,২৫৫ )
৩.শুধু মনে শান্তি লাভের জন্যে নজরুল এই গৃহী যোগীর নিকটে যায়নি, সে স্থুল দেহে পুত্র বুলবুলকে অন্তত একটি বার দেখতে চেয়েছিল। ডক্টর সুশীর কুমার গুপ্ত নজরুলের পরম বন্ধু শ্রী নলিনীকান্ত সরকারের লেখা হতে লিখেছেন, “ বরদাচরণের যোগশক্তির প্রভাবে নজরুল তার মৃতপুত্র বুলবুলকে একবার স্থুল দেহে দেখতে সমর্থ হন”। ( মুজাফ্ফর, ২০০৬, ২৪৩ )
৪. নজরুল আধ্যাত্বিক দিকে ঝুঁকে পড়ার কারণই সম্ভবত বুলবুলের মৃত্যু শোক। এর আগে শোক থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য তিনি হাসির গান লিখতে গিয়ে একা একা বসে কেঁদেছেন। ; এও তাঁর বন্ধুদের কেউ কেউ দেকেছেন। আধ্যাত্বিকতার দিকে পা দেবার কারণই ছিল বুলবুলেরচোখের দেখা পাওয়া। সেই আশায় তিনি লালগোলা হাইস্কুলের হেডমাস্টার বরদাচরণ মজুমদারের কাছে যান নলিনীকান্ত সরকার মশাইকে সঙ্গে নিয়ে। সিদ্ধযোগী বলে মজুমদার মশাইয়ের খ্যাতি ছিল- তবে তিনি সংসার ত্যাগী ছিলেন না। তিনি গৃহী যোগী ছিলেন। শোনা যায় যে, বরদাচরণ নজরুলের এই কামনা চরিতার্থ করছিলেন- নজরুলের চোখের সামনে বুলবুল এসে দাঁড়িয়ে ছিল। এরপর স্বভাবত:ই নজরুল মজুমদার মশাইয়ের সঙ্গে হামেশা দেখা করতে লাগলেন। মজুমদার মশাই শ্মশানে গিয়ে কালী সাধনা করতেন। [গৌরীশঙ্কর ( বিশ্বনাথ সম্পাদিত,১৯৯৭,১৩০ )]
৫. ১৯২৯ সালের ২০শে মার্চ তারিখে মীরাট কমিউনিটি ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার সংশ্রবে গ্রেফতার হয়ে আমি মীরাটে চলে যাই। নানা ঘাটের জল খেয়ে আমি আবার কলকাতায় ফিরে আসি ১৯৩৬ সালের জুন মাসের শেষ সপ্তাহ্ েফিরে এসে আমার পূর্ব পরিচিত নজরুলকে আর পাইনি। ( মুজাফ্ফর;২০০৬,২৫৫ )
৬. ১৯৩৬ সাল, দেশ মাতার ভক্ত সন্তান নজরুল মহাকালীর ভক্ত হয়ে উঠলেন। লালগোলায় হাইস্কুরের শিক্ষকের সঙ্গে ঘটনাক্রমে কবির সাক্ষাৎ হলো। তিনি গৃহতান্ত্রিক বরদাচরণ আগাম বাগীশ। ( প্রাণতোষ ১৩৭০;২৬৪ ।
(চলবে )