সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ২৫: স্বপন চক্রবর্তী

Home Page » সাহিত্য » সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ২৫: স্বপন চক্রবর্তী
বৃহস্পতিবার ● ৩০ জুন ২০২২


 স্বপন কুমার চক্রবর্তী

ব্ঙ্গ-নিউজ: গবেষক শাহিদা খাতুন লিখেছেন –

ঘাটু গান বিলুপ্তপ্রায় এক প্রকারের লোক গীতি। ঘাটে ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে এ গান গাওয়া হয় বলে এর নাম হয়েছে ঘাটের গান বা ”ঘাটু গান”। নটী বেশে কিশোর বালক নৃত্যসহ এ গান পরিবেশন করে। রাধা-কৃষ্ণের প্রণয়লীলা ও দৈনন্দিন জীবনের বিচিত্র ঘটনা ঘাটু গানের বিষয বস্তু। ঘাটু গানের উৎপত্তি বিষয়ে বলা হয় ষোল শতকের প্রথম দিকে শ্রীহট্টের আজমিরিগঞ্জ নিবাসী জনৈক বৈষ্ণবাচার্য শ্রীকৃষ্ণের প্রেমে বিবাগী হয়ে বিরহিনী রাধা বেশে কৃষ্ণের আগমণ অপেক্ষায় দিনাতীপাত করতে থাকেন। ধীরে ধীরে তাঁর বহু শিষ্য গড়ে ওঠে। শিষ্যদের মধ্যে বালক শিষ্যদের রাধার সখী সাজিয়ে তাদের নিয়ে নেচে নেচে বিরহ সঙ্গীত গাওয়া হতো। ক্রমে ক্রমে নারী বেশী এ বালক শিষ্যরা ঘাটু নামে পরিচিত হয় এবং এদের নিয়েই গড়ে ওঠে ঘাটুর দল।
এক বা একাধিক সুদর্শন কিশোর হয় ঘাটু আসরের কেন্দ্রীয় চরিত্র। এদের অনেকে বংশ পরম্পরায় ঘাটু গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। ঘাটুদের সুকন্ঠের অধিকারী অল্প বয়েসী এবং লম্বা কেশী হতে হয়। এদের যুবতী-সুলভ রূপ-লাবণ্য পোশাক-পরিচ্ছেদ সুমধুর কন্ঠ অঙ্গভঙ্গি নৃত্য প্রভৃতি দর্শক শ্রোতাদের মুগ্ধ করে।
ঘাটু গানে রাধাকৃষ্ণের কাহিনী থাকলেও এতে সম্পূর্ণ ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত লৌকিক ও আদিরসেরই প্রাধান্য থাকে। প্রধানত বর্ষা মৌসুমে যখন নদ-নদী, খাল-বিল পানিতে ভরা থাকে তখন নৌকায় ঘাটু গানের আসর বসে। এ নৌকা গ্রামের ঘাটে ঘাটে ভিড়িয়ে গান শোনানো হয়। লোকালয়েও ঘাটু গানের আসর বসে। তাদের মধ্যে বিশেষ করে রাধা-কৃষ্ণের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে গানের প্রতিযোগীতা চলে। অনুষ্ঠান শেষে বিচারক বিজয়ী দলের নাম ঘোষণা করেন।
ঘাটু গানের দলের প্রধান অর্থাৎ মূল গায়েনকে বলে সরকার। এ গানে বাদ্যযন্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হয় ঢোল ,তবলা, বেহালা, সারিন্দা, মন্দিরা, বাঁশী, করতাল হারমোনিয়াম প্রভৃতি। ঘাটু গানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক গ্রামের জোতদার এবং এর প্রধান কর্মী সমকামী যুবকরা। এ গান প্রধানত ময়মনসিংহের পূর্বাঞ্চল ,কুমিল্লা জেলার উত্তরাঞ্চল এবং সিলেট জেলার পশ্চিম অঞ্চলে এক সময় ব্যাপক ভাবে প্রচারিত ছিল। বর্তমানে এ গানের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছে।
”আমাদের কিশোরগঞ্জ” পত্রিকাটির ১২ মে, ২০১২ তারিখের ”তথ্য চিত্রে হাওর অঞ্চল ” অংশের লোক সাহিত্য কলামে ঘাটু গান সম্পর্কে লিখেছেন যে, “ ঘাটু গানের মুল বিষয় বস্তু ছিল রাধা-কৃষ্ণের প্রণয় লীলা। চিরায়ত এ প্রেম লীলাকে কেন্দ্র করে রচিত হতো ঘাঁটু গান। আসরে উঠে ঘাঁটু প্রথমে বন্ধনা গাইতেন। পরে প্রেম, প্রেমতত্ব ,মান অভিমান, বিচ্ছেদ,মিলন,সন্যাস,প্রভৃতি বিষয় অবলম্বন করে প্রবাহিত হতো তার গীত ধারা। শ্রীকৃষ্ণের মথুরা গমনের পর অথবা তার সান্নিধ্য না পেয়ে রাধার বিরহ উপলক্ষ্য করে রচিত বিচ্ছেদ গান গুলোতে পরিলক্ষিত হতো চিরন্তন বেদনার সুর। অনেকের মতে ছম ঘাটু গানের রাধা-কৃষ্ণের বিরহ সংগীত থেকেই নেত্রকোনার অন্যান্য লোক সংগীত “রাই ধারা” ও শ্যাম ধারার উদ্ভব। ছম জাতীয় মূরলী শ্রেণীভুক্ত এমনই একটি ঘাটু গান-
” আমার মনের বেদন, সে বিনে কেউ জানে না
কালা যখন বাজায় বাঁশী, তখন আমি রান্তে বসি
বাঁশী সুরে মন উদাসী, ঘরে থাকতে পারি না।।
হিন্দু ধর্মের রাধা-কৃষ্ণের কাহিনীই ঘাটু গানের মূল প্রতিপাদ্য হলেও এক পর্যায়ে ইসলাম ধর্মের নানা বিষয় সহ নর-নারীর সাধারণ প্রেম-বিরহ এবং সমসাময়িক বিষয় বস্তুও ওঠে আসে ঘাঁটু গানে। কারণ হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের লোকজনই ছিল ঘাঁটু গানের দর্শক-শ্রোতা।
দুঃখের বিষয় ,মূল গানে গাঁটু শব্দ থাকলেও এখনকার অনেক গানে ঘাঁটুর স্থলে পল্লী গান/ মুর্শিদী গান শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের গানেও ঘাঁটু গানের অস্তিত্ব পাওয়া যায় । যেমন-
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
গ্রামের নৌজোয়ান, হিন্দু-মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান আর ঘাটু ( মুর্শিদী ) গান গাইতাম
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।
চলবে-

বাংলাদেশ সময়: ২১:০৪:৫৯ ● ৫১০ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ