বঙ্গনিউজঃ নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে আওয়ামী লীগসহ মাত্র চারটি দল ইভিএমে আগামী নির্বাচন করার বিষয়টি সমর্থন করেছে।
সন্দেহ, সংশয়, অবিশ্বাস, আস্থাহীনতা এবং বিতর্ক থাকলেও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনেই ইভিএমে ভোট গ্রহণ চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ইভিএম নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় বিষয়টি স্পষ্ট করেই বলেছে দলটি।
ইভিএমে (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) আগামী নির্বাচন করার বিষয়ে আওয়ামী লীগের এমন মনোভাবের সঙ্গে প্রায় প্রশ্নহীনভাবে একমত পোষণ করেছে মাত্র তিনটি দল। দল তিনটি হলো আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪–দলীয় জোটভুক্ত ওয়ার্কার্স পার্টি, সাম্যবাদী দল ও গণতন্ত্রী পার্টি। অন্যরা ইভিএম নিয়ে কমবেশি সংশয়–সন্দেহ, আস্থাহীনতা ও অবিশ্বাসের কথা বলেছে।
ইভিএম নিয়ে নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পর্যায়ক্রমে তিন দফায় আলোচনা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গতকাল মঙ্গলবার শেষ দিনে ইসির মতবিনিময় সভায় আমন্ত্রিত ছিল আওয়ামী লীগসহ ১৩টি দল। এর মধ্যে অংশ নেয়নি সিপিবি, বাসদ, এলডিপি ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি।
ইসি আয়োজিত সভায় আওয়ামী লীগের ছয় সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সভা শেষে বেরিয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আমরা ৩০০ আসনেই ইভিএম চাই। মন থেকে চাই। চেতনা থেকে চাই।’
সংসদের ৩০০ আসনে ইভিএমে নির্বাচন করতে ইসি কতটা সক্ষম—এমন প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এটা তাদের (ইসি) এখতিয়ার।’
এর আগে সভার ভেতরে দেওয়া বক্তব্যে ওবায়দুল কাদের বলেন, ইসির এখন দেড় লাখ ইভিএম রয়েছে, যা দিয়ে ৩১ শতাংশ কেন্দ্রে ভোট করা সম্ভব। আগামী নির্বাচনে ইভিএমের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করার জন্য ইসির প্রতি আহ্বান জানান তিনি। এ সময় তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ মনে করে, ইভিএমসহ প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ার কারণে সব কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বেড়েছে। ইভিএমের কারণে জালিয়াতি ও ভোট চুরি বন্ধ হয়েছে। ইভিএম পদ্ধতি জনগণের কাছে জনপ্রিয় ও সবার ব্যবহারযোগ্য করার লক্ষ্যে ইসিকে এখন থেকেই প্রচার–প্রচারণার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতেও আহ্বান জানান তিনি।
ইসির সভায় আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলে আরও ছিলেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ ও ফারুক খান, উপদেষ্টা পরিষদের মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন (চুপ্পু), দলের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সেলিম মাহমুদ ও উপদপ্তর সম্পাদক সায়েম খান।
গতকালের সভায় আওয়ামী লীগের পাশাপাশি অংশ নিয়েছে ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, তরিকত ফেডারেশন, গণফোরাম, বিকল্পধারা, সাম্যবাদী দল, গণতন্ত্রী পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাপ ও মুক্তিজোট। এর মধ্যে সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া সভায় বলেন, আওয়ামী লীগের প্রস্তাবের সঙ্গে তাঁরা একাত্মতা প্রকাশ করে ইভিএমের প্রতি সমর্থন জানান।
ইভিএম পদ্ধতিতে কোনো আপত্তি নেই বলে উল্লেখ করেন ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা। তবে তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে সব কটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা উচিত। কিন্তু ইভিএম বিষয়ে যেসব প্রশ্ন আছে, তা নিয়ে পৃথকভাবে আলোচনা হওয়া দরকার।
ইভিএমে কারসাজির ভয়
ইসির সঙ্গে গতকালের সভায় ইভিএমের সরাসরি বিরোধিতা করে বক্তব্য দিয়েছে জাসদ, গণফোরামসহ চারটি রাজনৈতিক দল। গণফোরামের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আইনজীবী সুরাইয়া বেগম সভায় বলেন, ইভিএম একটি ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এর মাধ্যমে একজন ভোটার তাঁর পছন্দের প্রতীকে ভোট দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারে না। তা ছাড়া ইভিএমে খুব সহজেই জালিয়াতির মাধ্যমে ফলাফল পরিবর্তন করার অনেক ‘মেকানিজম’ রয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) স্থায়ী কমিটির সদস্য মোশারফ হোসেন বলেন, ইভিএমে জাতীয় নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না। কারণ, এই পদ্ধতি এখনো সব মানুষের কাছে পরিচিত নয়।
ইভিএমের ওপর আস্থা নেই উল্লেখ করে বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (বাংলাদেশ ন্যাপ) মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া বলেন, ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে সন্দেহ ও অবিশ্বাস আছে। দেশের জনগণ মনে করে, ইভিএম স্বয়ংক্রিয়ভাবে ‘ভোট চুরির বিশ্বস্ত যন্ত্র’।
প্রযুক্তি হিসেবে ইভিএম উন্নত পদ্ধতি হলেও মানুষ এই যন্ত্র ব্যবহার করে ভোট দিতে পারবে কি না, সে প্রশ্ন তোলেন বিকল্পধারা বাংলাদেশের মহাসচিব আব্দুল মান্নান। সারা দেশের সব ভোটকেন্দ্রের সব বুথে ইভিএম সরবরাহ ও তা নিয়ন্ত্রণ ইসি করতে পারবেন কি না, তা নিয়েও নিজের সংশয়ের কথা সভায় তিনি তুলে ধরেন।
সাড়া দেয়নি ১১ দল
ইভিএম নিয়ে আলোচনার জন্য নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে অংশ নেয়নি মোট ১১টি দল। তারা হলো বিএনপি, সিপিবি, বাসদ, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)।
এর মধ্যে শুরু থেকেই বিএনপি বলে আসছে, বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিয়ে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। বিএনপির মূল লক্ষ্য নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করা। আর শুরু থেকেই বিএনপি ইভিএমের বিরোধিতা করে আসছে।
বিএনপিকে দ্বিতীয় ধাপে ২১ জুন আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তবে দলটি অংশ নেবে না বলে আগেই বলেছিল।
ইভিএম নিয়ে প্রথম ধাপে জাতীয় পার্টিসহ ১৩টি দলের (অংশ নেয়নি তিনটি দল) সঙ্গে ১৯ জুন আলোচনা করে ইসি। সভায় জাতীয় পার্টি আগামী নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতা করেছে।
অন্যদিকে গতকালের সভা বর্জন করে ইসিকে দেওয়া এক চিঠিতে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) বলেছে, ইভিএম এখনো বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেনি। অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ইভিএমে ভোটদান পদ্ধতির বিরোধিতা করেছে। তাই আগামী নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের প্রয়োজন নেই।
আর বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) সভা বর্জনের কারণ হিসেবে ইসিকে চিঠি দিয়ে বলেছে, বর্তমান নির্বাচন কমিশন যে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে না, তার কিছু লক্ষণ ১৫ জুন অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দেখা গেছে।
গতকালের সভায় উপস্থিত ছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল, নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান, মো. আলমগীর ও মো. আনিছুর রহমান। করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা সভায় উপস্থিত থাকতে পারেননি। এ ছাড়া ইসি সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার, বাংলাদেশ মিশন টুলস ফ্যাক্টরির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেজর জেনারেল সুলতানুজ্জামান মো. সালেহ উদ্দিন, সেনাকল্যাণ সংস্থার চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম প্রমুখ সভায় উপস্থিত ছিলেন।
সভার শুরুতে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, অনেক রাজনৈতিক দল (গত দুই সভায়) ইভিএমের বিপক্ষে বলেছে। আর সভা শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে কি না, তা পর্যালোচনা করবে ইসি। ইসির সামর্থ্য কতটা রয়েছে, সেটা দেখা হবে। আদৌ ইভিএম ব্যবহার করা হবে কি না বা সম্পূর্ণ কিংবা অর্ধেক আসনে ব্যবহার হবে কি না, সে বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত হবে।