বঙ্গ-নিউজ: সংস্কৃত আলংকারিকদের মতে আশির্বচন নমোক্রিয় অথবা বস্তু নির্দেশ দ্বারা কাব্যারম্ভ হয়। সাহিত্য দর্পণে বিশ্বনাথ দেখিয়েছেন মহাকাব্যের আখ্যান বস্তু হবে পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক এবং ( ১ ) মহাকাব্য হবে নযটি সর্গে বিভক্ত। ( ২ ) বেশী হলে ৩০ টি সর্গ। ( ৩ ) বিভিন্ন সর্গে বিভিন্ন সর্গ থাকবে না। একই ছন্দে লিখা হবে। ( ৪ ) মহাকাব্যের নায়ক হবে সৎবংশজাত , ধীরোদাত্ত গুনান্বিত ক্ষত্রিয় বা কোন দেবতা। ( ৫ ) এতে জল ক্রীড়া থেকে যুদ্ধের বর্ণনা থাকবে। ( ৬ ) শৃংগার ,বীর, শান্ত রসের যে কোন একটি মহাকাব্যের অঙ্গীরস হবে। ( ৭ ) নামকরণ হবে তাৎপর্য অনুসারে। ভামহ, দন্তী বিশ্বনাথের মহাকাব্যের লক্ষণ নির্ধারনের প্রয়াসকে প্রশংসা করা যায়। এদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী নায়কের জয় বা আত্ম প্রতিষ্ঠার মধ্যে মহাকাব্যের সমাপ্তি হবে। যেমন কায়কোবাদের অমর সৃষ্টি রয়েছে “ মহাশ্মশান” মহাকাব্য আলাউলের রয়েছে ‘পদ্মাবাতী” মাইকেল মধুসূদনের রয়েছে মেঘনাদবধ ।
ঘেটু গান, ঘাঁটু গান বা ঘাডু গান।
ঘেটু গান উত্তরাঞ্চলের কোন পালা বা গান নয়। সম্পূর্ণ ভাবে দক্ষিণ বঙ্গ তথা ভাটি অঞ্চলের একটি গান। কুশান গানে যেমন ছেলেরাই মেয়েদের ভুমিকায় অভিনয় করে থাকে, ঠিক তেমনি ঘেটু গানের ক্ষেত্রেও ঘটে। তাই প্রসঙ্গক্রমে এই ঘেটু গান সম্পর্কেও দুএকটি কথা বলতে হচ্ছে।
ঘেটু বা ঘাটু গান মূলত রাধা-কৃষ্ণের কাহিনী অবলম্বনে নাচ-গান ও অভিনয়ে মঞ্চস্থিত এক প্রকার লোক পালা। এটি সর্ব প্রথম তদানীন্তন শ্রীহট্ট জেলার একটি আঞ্চলিক গান ছিল। ঘাটে ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে এই গান অনুষ্ঠিত হতো বলে এটিকে ঘাটু গান নামে অভিহিত করা হয়। ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ নেত্রকোনা সিলেট ও আসামের গোয়ালপাড়া সহ বিভিন্ন অঞ্চলে এই পালা গানের অবস্থান ছিল। ঘেটু গান সম্পর্কে ছোট বেলা থেকেই শোনে এসেছি। কিন্তু কোন দিন দেখা হয়নি প্রত্যক্ষ ভাবে। কারণ অভিভাবকের কড়া নিষেধাজ্ঞা ছিল। ছোট বেলা থেকেই এই গান সম্পর্কে বিরূপ একটা ধারণা নিয়ে বড় হয়েছি। আমরা নিজেরা যদি কখনো একটু স্টাইল করে চুল আঁচড়েছি বা চুল একটু বড় রেখেছি তখনই অভিভাবক হোক বা প্রতিবেশী , সবাই ভর্থৎসনা করে বলতো যে, ঘাটুর মতো সাজ করতে শুরু করেছে। কারণ ঘাটুদের প্রথম বৈশিষ্টই ছিল চুল খুব বড় বড় করে রাখা। আমাদের গ্রামে একটি হাট ছিল। ”সুঠিয়ার হাট” নামক এই হাটে বড় দাদার সঙ্গে প্রায়শই আমি যেতাম। মাঝে মাঝে দেখেছি কোথাও কোন দোকানের বাড়ান্দায় বা অন্যত্র কোথাও লোকের খুব ভীড়। কৌতুহল নিয়ে নিকটে গিয়ে দেখেছি যে, একটি সুন্দর ফুট ফুটে বালক বসে আছে। তার মাথার চুল বেশ লম্বা। জিজ্ঞেস করে জানা গেলো যে, সে ঘাটু। এইভাবে ছোট বেলা থেকেই ঘাটু সম্পর্কে একটা মন্দ ধারণা নিয়ে বড় হয়েছি। ঘাটু গানের মূল উদ্দেশ্য ছিল রাধা-কৃষ্ণের প্রণয় ও বিরহ নিয়ে কীর্তন করা। কালক্রমে এটি একটি ভক্তি গীতির পরিবর্তে পরিণত হয় অশ্লীল নৃত্য-গানে।
অতি দরিদ্র ঘরের ছেলেদেরকে টাকার লোভ দেখিয়ে সমাজের জোতদার, জমিদার বা প্রভাবশালী বিত্তবানেরা ঘাটু দলে ভীড়াতো। এই ঘাটুদেরকে নাচ-গান অভিনয়ে একান্তভাবেই দক্ষ করে তুলা হতো। এক সময়কার বৃহত্তর ময়মনসিংহ তথা ভাটি অঞ্চলের একটি প্রিয় ঝুমুর যাত্রা পালা ছিল এই ঘাটু গান। পরে জমিদার ও বিত্তবান প্রভাবশালীদের ঘৃণ্য লালসার কারণে এটি একটি ঘৃণ্য পেশায় পরিণত হয়। অসহায় দরিদ্র ছেলেরা না পেতো কোন শিক্ষা না পেতো সামাজিক মর্যাদা। পৃষ্ঠপোষক যারা ছিল তারাই নষ্ট হয়ে যায়। আর ভাগ্যাহতো হয় এই সব নিষ্পাপ অবুঝ শিশুরা। ফলে এই শিল্পটি আজ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পৃষ্ঠপোষক এই বিত্তবান জমিদারেরা পারিবারিক ভাবেও অশান্তি ডেকে আনতে পিছ পা হয় নাই। জমিদারদের স্ত্রীগণ এই ঘাটু পুত্রদেরকে নিজের সতীন বলে মনে করতো। ঘৃণ্য লালসায় উন্মত্ত জমিদারগণ ঘাটুপুত্রদের শয্যাসঙ্গি করতে শুরু করে দেয়। এই ছেলেদের সংগীত প্রতিভা মর্যাদাহীন হয়ে যায়। এক সময় এসে সৌখিনদারগণ নিজের স্ত্রী সন্তানের চেয়েও ঘাঁটুদের অধিক কদর করতে থাকে। কিংবদন্তি আছে যে, কথা প্রসঙ্গে অনেকে বলতো যে, বউ পালা আর ঘাঁটু পালা সমান কথা। এক সময় ঘাঁটু লালন পালন ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। তাই ঘাটু কেনা-বেচা নিয়ে ঝগড়াও হতো ,মারামারিও হতো। অর্থবিত্ত শালী সৌখিনদারদের বিকৃত লালসার শিকার হতেও থাকে পেটের তাড়নায় হয়ে ওঠা পেশাদার ঘাটুরা। ঘাঁটু ছোকড়া ও সৌখিনদারদের মধ্যে গড়ে ওঠে বিকৃত যৌন জীবন। আস্তে আস্তে লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে ঘাঁটু সৌখিন দারদের কুকীর্তির কথা। ক্রমে ক্রমে এই অস্বাভাবিক পন্থাটি সামাজিক স্বীকৃতিও পেয়ে যায়। সমাজে ঘটতে থাকে নানা রকম অসামাজিক ও কুরুচিপূর্ণ কার্যকলাপ। বিকৃত চাহিদা সম্পন্ন মানুষের জন্য রচিত হতে থাকে অশ্লীল গান। গান শেষে ঘাঁটুদেরকে রাত কাটাতে হতো সৌখিনদারদের বাড়িতে। আর সৌখিনদারদের বউরা সারা রাত কেঁদে কেঁদে কাটাতো । ঘাঁটু ছোকড়াকে যে তারা সতীন হিসাবে দেখতো তার আভাস পাওয়া যায় এমন একটি গানে-
” আইছে সতীন ঘেঁটু পোলা
তোরা আমারে বাইন্ধা ফেলা
পুব হাওরে নিয়া।
জানা যায় , ঘেঁটু বালকের নেশায় উন্মত্ত হয়ে কেউ কেউ জমি-জমা বিক্রি করে ফকির হয়েছে। আবার কেউ কেউ স্ত্রীকে তালাক দিয়ে ঘাঁটুকে নিয়ে জীবন কাটিয়েছে। ঘাঁটুকে কেন্দ্র করে সমাজে শুরু হয় বিকৃত জীবন ধারা। নেমে আসে নৈতিক অবক্ষয়।
যাক আমার প্রতিক্রিয়ার চেয়ে বরং যারা এ সব বিষয়ে প্রচুর গবেষণা করেছেন আমি তাদের হুবহু কিছু উদ্ধৃতি তুলে ধরছি।
চলবে-