বঙ্গ-নিউজ: বৃহত্তর রংপুর তথা লালমনির হাট,কুড়িগ্রাম এ সব অঞ্চলে এক সময় প্রচুর পরিমানে কুশান গানের পালা অনুষ্ঠিত হতো। চৈত্র সংক্রান্তি, দুর্গাপূজা, সরস্বতী পূজা পহেলা বৈশাখ অথবা যেকোন অনুষ্ঠানের সময় এই কুশান গানের আয়োজন করা হতো। শিল্পী হিসাবে দেখেছি মহেশ চাঁন গিদাল ও ধরণী গিদালকে। তাঁদের সাথে অংশ নিতেন অমনি ( রমণী) দোয়ারী ও হরিবোলা দোয়ারী। মোটামোটি ভাবে তাঁরা জনপ্রিয় ছিলেন। এখন আর তাঁরা বেঁচে নেই। তবে বাংলাদেশের একজন অত্যন্ত প্রথিতযশা ও জনপ্রিয় কুশান শিল্পী হিসেবে এখন রয়েছেন কৃপাসিন্ধু রায়। কুড়িগ্রামের রাজার হাট অঞ্চলের এই শিল্পীর খ্যাতি রয়েছে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও। তিনি প্রায় পাঁচ দশকেরও অধিক সময় ধরে এই কুশান পালা গানের সাথে জড়িত। তিনি ২০০৭ সালে পুরাতন লোকগীতি গানের জন্য আমন্ত্রিত হয়ে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত সার্ক সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে প্রায় সপ্তাহব্যাপি তার কুশান পালা মঞ্চস্থিত হয় এবং প্রভূত প্রশংসা লাভ করে। কুশান গানের এই জীবিত কিংবদন্তির একজন সহযোগী হিসাবে জনাব আয়নল হক সর্বদাই কৃপাসিন্ধুকে সঙ্গ দিয়ে থাকেন। তিনি একজন দক্ষ ও জনপ্রিয় দোয়ারী। এই আয়নল হকের কুশান গানের অভিজ্ঞতাও প্রায় কৃপাসিন্ধুর সম পর্যায়ের। অনর্গল হাসির খোড়াক যোগাতে সক্ষম এই দোয়ারী নৃত্যে-অভিনয়ে ও সংলাপে সমান পারদর্শি। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আমন্ত্রণে ২০০৬ সাল হতে লোক-গানের অংশ হিসাবে কুশান গান পরিবেশন করে আসছেন কৃপাসিন্ধু রায়। গ্রামের জনপ্রিয় গান এখন শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চে। মাটির গান, গ্রাম্য মানুষের গান হলো কুশান গান। গ্রাম্য গান এখন টিকে আছে ঢাকার মতো ইট-পাথরের তৈরী আলোকোজ্বল অডিটরিয়ামে । বহু পুরস্কারও তিনি ( কৃপাসিন্ধু রায় ও তার দল ) অর্জন করেছেন। আর্থিক অনটনে দল চালাতে অক্ষম এই শিল্পীকে দিল্লীতে আমন্ত্রণ জানানো হলে নিজের গাভী বিক্রী করারও সিদ্ধান্ত নেন। ঢাকাস্থ শিল্পকলা একডেমী তখন তাঁকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে।
কুশান গানের শিল্পীরা এটাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে পারছে না। কারণ এই গান এখন বেশী চালু নেই। তেমনভাবে আর মঞ্চস্থ হয়না কোথাও। শিল্পীগণ এখন অন্য পেশার অবসরে এই শিল্পে সময় দিয়ে থাকেন। অপরদিকে এদের সাধারণ শিক্ষা এবং সংগীত বিষয়ক শিক্ষা গ্রহনের কোন সুযোগ নেই। নাচ-গানের সমন্বয়ে এই গান । তবুও এ সবের উপর কোন প্রশিক্ষণ গ্রহন করার কোন সুযোগ ওদের নেই। অপরদিকে রয়েছে আধুনিকতার সাথে প্রতিযোগিতা। তাই এই গান এখন দ্রুত অবলুপ্তির পথে।
পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, রামায়ণ একটি মহাকাব্য। মহাকাব্য কি এমন একটি প্রশ্ন মনে উদিত হয়। কেন মহাকাব্য ? এসব বিষয়ে আমি তো কোন ছাড়, অনেক মহারথিগণও এক মত হতে পারেননি। তবুও কিছুটা বইপুস্তক ঘেঁটে কিছু লেখা দেখে মহা ফাঁপড়ে পড়ে গেলাম। ভাবলাম এর মধ্যে প্রবেশ না করাই শ্রেয় ছিল। মহাকাব্য বলতে যে, অতিকায় কবিকৃতি বোঝায় তার নাকি যথার্থ সজ্ঞা নির্দ্ধারণ অসম্ভব। তাদের ভাষায়, এই সুপ্রাচীন সাহিত্য সৃষ্টি প্রাচ্যে-পাশ্চাত্যে স্বতন্ত্রভাবে বিকাশ লাভ করেছিল। তাই এর সজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্যে ভিন্নতা বিদ্যমান আছে। বাংলা মহাকাব্যের পরিচয় লাভ করতে হলে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের আদর্শ সম্পর্কে অবহিত থাকা প্রয়োজন। প্রাচ্য আদর্শানুসারে মহাকাব্যে সর্গ বিভাগ থাকবে এবং সর্গ সংখ্যা হবে অষ্টাধিক। এর উপজীব্য হবে পুরাণ ইতিহাস বা অন্য কোন সত্য ঘটনা। মহাকাব্য পাঠে ধর্ম অর্থ কাম ও মোক্ষ এই চতুর্বর্গ ফল লাভ হবে। নায়ক ধীরোদাত্ত গুণসম্বলিত এবং সদ্বংশজাত ক্ষত্রিয় বা দেবতা হবেন। পটভুমি স্বর্গ মর্ত্য ও পাতাল প্রসারী এবং তাতে যুদ্ধ প্রকৃতি, নগর ও সমুদ্রের বর্ণনা থাকবে। এতে শৃঙ্গার রস বীর রস ও শান্ত রস এই তিনটি রসের একটি প্রধান এবং অন্যান্য রস এর অঙ্গস্বরূপ হবে। নায়কের জয় বা প্রতিষ্ঠার মধ্যে মহাকাব্যের সমাপ্তি ঘটবে। আর পাশ্চাত্য আদর্শানুসারে মহাকাব্য বলতে বীরত্বব্যঞ্জক উপাখ্যান বুঝায়। নায়ক দেবতা না হলেও অসাধারণ ক্ষমতাশালী এবং মহৎ গুণ সম্পন্ন বীর হতে হবে। মহাকাব্য বীররস প্রধান হবে। প্রমথ চৌধুরীর মতে- এ যুগের কবিতা হচ্ছে হৃদয়ের স্বগতোক্তি । তাই সে উক্তি একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাসের চেয়ে দীর্ঘ হতে পারে না। আধুনিক মানুষের রসঘন আনন্দ বেদনা রূপায়ণের ক্ষমতা মহাকাব্যের নেই। কথা সাহিত্যের উপযোগীতা ও জনপ্রিয়তা পাঠককে মহাকাব্য বিমূখ করেছে। এ বিষয়ে রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী মন্তব্য করেছিলেন, “ সুনিপুণ শিল্পী এ কালে তাজমহল গড়িতে পারেন, কিন্তু পিরামিডের দিন বুঝি একেবারেই চলিয়া গিয়াছে। “ এ বিষয়ে কৌতুক করে ক্ষণিকা কাব্যে রবীন্দ্র নাথ বলেছিলেন, “
আমি না রব মহাকাব্যে-
সংরচনে
ছিল মনে-
ঠেকল কখন তোমার কাঁকন-
কিংকিনীতে,
কল্পনাটি গেল কাটি হাজার গীতি-
মহাকাব্য সেই অভাব্য
দুর্ঘটনায়-
পায়ের কাছে ছড়িয়ে আছে
কণায় কণায়।
তিনি আরো বলে ছিলেন, “ কালে কালে একটি সমগ্র জাতি যে কাব্যকে একজন কবির কবিত্বশক্তি আগ্রহ করিয়া রচনা করিয়া তুলিয়াছেন, তাহাকেই যথার্থ মহাকাব্য বলা যায়। এই জাতীয় মহাকাব্য পুরাতন বস্তুর অনুকরণ মূলক সৃষ্টি নয়, পুরাতনকে উপলক্ষ করিয়া সম্পূর্ণ নতুন সৃষ্টি। “ উল্লেখ্য যে, সাহিত্যের সকল শাখায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সদর্পে বিচরণ থাকলেও তিনি কোন মহাকাব্য লিখেন নি।
চলবে-