সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ২২ : স্বপন চক্রবর্তী

Home Page » সাহিত্য » সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ২২ : স্বপন চক্রবর্তী
শুক্রবার ● ২৪ জুন ২০২২


স্বপন কুমার চক্রবর্তী

বঙ্গ-নিউজ:   ** যখনই আপনি ইন্দোনেশিয়ার বিমানে উঠবেন তখনই প্রথম চমকটি খাবেন। কারণ ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় এয়ারলাইন্সের নাম “ গারুড়া” ( গরুড় ) ইন্দোনেশিয়া”। সেই হিন্দু পুরাণের বিষ্ণুর বাহন গরুড় এখন সমগ্র ইন্দোনেশিয়াকে পিঠে চাপিয়ে সারা বিশ্ব ঘোরাচ্ছেন। সারা বিশ্ব লেখে এয়ারলাইন্স বা এয়ারওয়েজ কিন্তু ইন্দোনেশিয়া লেখে না। কারণ আজও দেশটি বিশ্বাস করে আকাশে পরিবহনের কপিরাইট একমাত্র গরুড়ের। তাই তারা লেখে “ গরুড় ইন্দোনেশিয়া”।
** তাদের জাতীয় স্মারক হলো “ গারুডা পনকাসিলা” ( গরুড় পঞ্চশীলা। ।
** ইন্দোনেশিয়ার মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের সরকারি ম্যাসকট হলেন হানুমান (পবনপুত্র হনুমান )। ১৯৯৭ সালে জাকার্তায় অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসের অফিশিয়াল ম্যাসকটও ছিলো হনুমান।
** ২০,০০০ রুপীয়াহ’র নোটে পাবেন সিদ্ধিদাতা গণেশের ছবি ( ইদানিং আরও কয়টি নোটে তা পাওয়া যায়) । এর পিছনের কারণ হলো, একবার নাকি ইন্দোনেশিয়া মারাত্মক অর্থনৈতিক মন্দায় পড়ে। সিদ্ধিদাতা গণেশের ছবি নোটে ছাপার পর দেশের সুদিন ফিরে আসে।
** ইন্দোনেশিয়ার সেরা সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ Institut Teknologi Bandung ( হ্যাঁ, এই বানানই লেখা আছে) এর লোগোতেও গণেশের ছবি।
** ইউনিভার্সিটি গুলোর নামেও হিন্দুত্বের প্রভাব লক্ষণীয়। যেমন, গাজা মাদা ইউনিভার্সিটি ( হিন্দু মাজাপাহিত সাম্রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী “ গাদজাহ মাদা’র নামে) , শ্রী ভিজায়া ইউনিভার্সিটি ( বিজয়া ইউনিভার্সিটি) সরস্বতী ইউনিভার্সিটি ইত্যাদি।

সংগৃহীত ছবি- গারুড়া ইন্দোনেশিয়া
** ইন্দোনেশিয়ার বেশীর ভাগ ইউনিভার্সিটিতে রামায়ণ ও মহাভারত কমপলসারি সাবজেক্ট। এখানে রামায়ণকে কাকাউইন রামায়ণ বলা হয়। উল্লেখ্য যে, ইদানিং সৌদি আরবেও রামায়ণ ও মহাভারত পড়ানো হচ্ছে।
** হোটেল, দোকান ও সরকারি বেসরকারি অফিসের সামনে ডান হাঁটু মুড়ে বসা এবং হাতে তরবারি ও ঢাল হিন্দু মিথোলজির দ্বারপালের মূর্তি বসানো থাকে।
** ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় ব্যাংকের নাম “ কুবেরা ব্যাঙ্ক “ যা হিন্দু মিথোলজির সম্পদের দেবতা কুবেরের নামে নামাঙ্কিত। এছাড়াও আছে সিদ্ধিদাতা গণেশের নামে ”গানেশা ব্যাঙ্ক”। ব্যাঙ্কগুলোর দরজায় আবার দুটো করে দ্বারপালের মূর্তি থাকে।
** রাজধানী জাকার্তার কেন্দ্রস্থলে অবস্থান করছে সুবিশাল রথে কৃষ্ণ ও অর্জুনের একটি ভাষ্কর্য। এই ‍শিল্প নিদর্শনটির খ্যাতি জগতজোড়া।
** ইন্দোনেশিয়ার ডাকবিভাগ প্রত্যেক বছর প্রচুর নতুন নতুন স্ট্যাম্প প্রকাশ করে- যার বেশিরভাগই রামায়ণ ও মহাভারতের চরিত্রগুলি নিয়ে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ইন্দোনেশিয়ার স্ট্যাম্পে পাবেন অর্জুনের ছবি, ,কৃষ্ণের ছবি, হনুমানের ছবি এবং এই দুই মহাকাব্যের বিভিন্ন দৃশ্যের ছবি। ইন্দোনেশিয়ার প্রতিটি অংশে এই দুইটি মহাকাব্যের ওপর পটচিত্র,পুতুল ,ভাষ্কর্য পাবেনই পাবেন।
** ইন্দোনেশিয়ার বেশির ভাগ মুসলিম নারীপুরুষের সংস্কৃত নাম, আরবী নয়। কারণ যে দেশের ভাষার নাম ” বাহাসা” যার সংস্কৃত অর্থ ভাষা ( Language ) । তারা কি করে রাখবেন আরবী ভাষার নাম ? সংস্কৃত নামগুলি কালের প্রভাবে একটু পরিবর্তিত হয়েছে। জাতির জনক সুকর্ণর নামটিতে লুকিয়ে আছেন মহাভারতের মহাবীর কর্ণ। সুকর্ণর পিতা কর্ণের ভক্ত ছিলেন। কিন্তু তিনি কর্ণের কৌরব পক্ষে যোগদান মানতে পারেননি, তাই নাম দেন সু ( ভালো) –কর্ণ । সুকর্ণের মেয়ের নাম মেঘাবতি সুকর্ণপুত্রী ( ২০০১-২০০৪ দেশের প্রেসিডেন্টও ছিলেন) । এ ছাড়াও উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, জাকার্তার এক বিখ্যাত মুসলিম লেখিকার নাম “ সিটা ডেউই”, আসলে তাঁর নাম “ সীতা দেবী” । ইন্দোনেশিয়ার এক বিখ্যাত আর্মি জেনারেলের নাম ছিলো ”গাটট সুবারতো” । গাটট নামটা এসেছে ইন্দোনেশিয়ানদের প্রিয় চরিত্র ও মহাভারতের মহাশক্তিধর ঘটতকচ থেকে আর সুবারতো হলো ‘” সুব্রত””। সুসিলা ( সুশীলা ), সারাসবাটি ( সরস্বতী) ,সান্টি ( শান্তি) বিষ্ণুবর্দাণ ( বিষ্ণুবর্ধন) মুর্লিডারা ( মুরলীধর) ,মনহরা রাটনা দেউই ( মনোহরা রত্না দেবী ) সবকটিই হিন্দু নাম কিন্তু ধর্মীয় পরিচয়ে তারা সবাই মুসলিম।
** ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় পতাকাকে বলা হয় “ Sang Saka Merah-putih” ( পবিত্র লাল এবং সাদা ) এই পতাকাটি সম্পূর্ণভাবে ত্রয়োদশ শতকের এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় হিন্দু সাম্রাজ্য মাজাপাহিত সাম্রাজ্যের পতাকা দ্বারা প্রভাবিত। পতাকাটিতে অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রের মতো চাঁদ তারার চিহ্ন লক্ষনীয় ভাবে অনুপস্থিত।
** ইন্দোনেশিয়ার বালি হলো সবচেয়ে বেশী হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল। বালির জনসংখ্যার ৮৩% হিন্দু ধর্মভুক্ত। বালি এয়ারপোর্টটি বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় কোনো হিন্দু মন্দির। বালির প্রায় প্রতিটি বাড়িতে আম্রপল্লব ঝোলানো থাকে ইন্দোনেশিয়ার হিন্দুদের দেবাদিদেব “ Acintya” ( অচিন্ত্য)র প্রতি উৎসর্গ করে। প্রত্যেকদিন খাবার আগে ধূপ জ্বালানো ও পবিত্র জল ছিটানো বাধ্যতামূলক।
** ইন্দোনেশিয়া মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র হয়েও হিন্দু দেব দেবীর মূর্তি সারা দেশে ছড়িয়ে আছে। বালিতে ছড়িয়ে আছে অতিকায় রাম, অর্জুন, কৃষ্ণের মূর্তি। এমনকি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের রাজধানী জাকার্তায় ভীম ও হিড়িম্বা দেবীর পুত্র মহাপরাক্রমশালী ঘটৎকচের সুবিশাল মূর্তি আছে। যেখানে হিন্দুপ্রধান ভারতেই ঘটৎকচের কোনো মূর্তি নেই।
** ইন্দোনেশিয়ার জাভার বিখ্যাত প্রাম্বানান মন্দির প্রাঙ্গনে ১৯৬১ সাল থেকে প্রত্যেকদিনই একটি রামায়ণ ব্যালে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এটি যে কোনো স্টেজ শোয়ের ক্ষেত্রে একটি বিশ্ব রেকর্ড । এই ব্যালের কুশীলবদের বেশির ভাগই ইসলাম ধর্মানুসারী। তাঁরা বলেন “ ইসলাম আমাদের ধর্ম রামায়ণ আমাদের সংস্কৃতি”।
** ইন্দোনেশিয়ার জাভা থেকে সুগ্রীব সীতাকে খুঁজতে বেরিয়ে ছিলেন। জাভাবাসীরা মুসলিম হয়েও গর্ব অনুভব করেন। এখনো জাভাতে সেরাউ ( সরযু) নামের নদী আছে। সেমেরু ( সুমেরু) পর্বত আছে। যেগুলো খুবই বিখ্যাত ও পবিত্র স্থান।
** সারা বছর ধরে ইন্দোনেশিয়ায় রামায়ণ ও মহাভারতের ওপর পুতুল নাচ ও নৃত্যনাট্য চলে বিভিন্ন থিয়েটারে। ওরা ওয়ায়াং কুলিত ও ওয়ায়াং ওরাং বলে। গবেষকরা মনে করেন এই কলা শিল্পগুলি ওড়িশার “রাবণ ছায়া পুতুলনাচ “ ও রাঢ় বাংলার ছৌ নাচ দ্বারা প্রভাবিত ।
জানলে অবাক হবেন এখনো উড়িষ্যার কটকে কার্তিক পূর্ণিমায় সাতদিন ধরে “ বালি যাত্রা” বলে একটি উৎসব হয় । সুপ্রাচীন কালে উড়িষ্যা থেকে নৌপথে ইন্দোনেশিয়া গামী নাবিক ও বণিকদেরকে স্মরণ করতে ।
** ইন্দোনেশিয়ায় মসজিদ আছে ২,৩৯,৪৯৭টি ও মন্দিরের সংখ্যা রয়েছে ৩০,০০০ হাজারেরও বেশি। ভারত বাদ দিয়ে কোনো দেশে মাত্র ৩% হিন্দুর জন্য এতো সংখ্যায় মন্দিরের সংখ্যা বিরল। শুধু বালিতেই আছে ২০,০০০ এর বেশি মন্দির। এর মধ্যে বিখ্যাতটি হলো আগ্নেয়গিরি মাউন্ট আংগুগ ( আগুন)। এর পাদদেশে অবস্থিত বেশাখি ( বৈশাখি) দেবীর মন্দির। গোটা মন্দির তৈরি করা থেকে পাথর কেটে প্রতিমা তৈরি বেশিরভাগই করেন মুসলিম কারিগরগণ।
আজ পৃথিবী জুড়ে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার রণদামামা বাজছে। জেহাদ, ক্রুশেড, ধর্মযুদ্ধ অ্যাকটিভেট করার চেষ্টা চলছে। ইন্দোনেশিয়াতেও সে চেষ্টা হয়নি বা হচ্ছে না তা নয়। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার জনগণ ধর্মীয় গোঁড়ামি ও মৌলবাদকে কড়া হাতে প্রতিহত করেছে। হিন্দু ধর্মকে ইন্দোনেশিয়া থেকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা অতীতেও ব্যর্থ হয়েছে ভবিষ্যতেও হয়তো হবে ইন্দোনেশিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ উদারবাদী মুসলিম জনগন দ্বারা।
যে দেশের সংখ্যালগুরা বেশি নিরাপদ এবং যে দেশের সংখ্যা লঘুদের দেশ ত্যাগ করতে হয়না, নির্যাতীত হয়না, সেই দেশ ততো সভ্য ও গণতান্ত্রিক। তাই বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন ধর্ম হিন্দু ধর্মের পতাকা আজও নির্ভয়ে উড়ে চলছে বিশ্বের বৃহত্তম ও উদার মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়ায়। উল্লেখ্য যে, যে দেশে সংখ্যালঘুরা যত নিরাপদ এবং স্বদেশ ত্যাগে বাধ্য হয়না সেই দেশ ততো অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক। চলবে-

বাংলাদেশ সময়: ২০:৪৪:০০ ● ৫০৯ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ