বঙ্গ-নিউজ: কুশান গান-অধুনা আর একটি লোক গান হারিয়ে যেতে বসেছে। এক সময়ের জনপ্রিয় লোকসংগীত এই কুশান গান। বৃহত্তর রংপুর জেলার বহুলভাবে অনুষ্ঠিত একটি লোক গান। কুশান গানের পরিবর্তে এটাকে কুশান পালা গান বলেই আখ্যায়িত করা হয়। যে কোন পূজা-পার্বণ, জাতীয় দিবস বা কোন আনন্দ উৎসব হলেই এই পালা গানের আয়োজন করা হতো। এটা আয়োজনের জন্য খুব বেশী বড় মঞ্চ বা প্যান্ডেল না হলেও চলে। কারো বাড়ির আঙ্গিনা বা মাঠ অথবা উঠোনেও আয়োজন করা যায়। এই গানের আয়োজন করতে খরচও খুব বেশী ছিল না। ফলে আনন্দপ্রিয় বাঙ্গালী প্রায়শই এই গানের আয়োজন করতো। বিশেষ করে আমন ধান কাটা শেষ হলে কৃষকগণের অবসর সময়ে এই গানের আয়োজন হতো বেশী। শ্রোতাগণ বৃত্তাকারে বসে শোনতো এই পালা গান। মাঝখানে গোল করে বসে শিল্পীগণ। সেই শিল্পীগণকে প্রদক্ষিণ করে মুল গায়ক গান পরিবেশন করে থাকেন। তার সঙ্গে থাকে একজন দোয়ারী। এই দোয়ারী মুল শিল্পীকে সার্বিক সহযোগীতা করতে পারে। মুল শিল্পীর সাথে কন্ঠ মিলানো ছাড়াও বিশেষ ভুমিকা তার থাকে। মুলত দোয়ারী আসলেও একজন অভিজ্ঞ শিল্পীই হয়ে থাকে। প্রতিটি গান ও সংলাপ পরিবেশন কালে তার একটা দক্ষতার পরিচয় মিলে। প্রতিটি মুহুর্তে দর্শককে বিশেষ আনন্দ প্রদানে এই দোয়ারী এক অনন্য ভুমিকা পালন করে। এই দুজন ছাড়াও দলে থাকে বেশ কয়েকজন ছেলে- যারা সালঙ্করা নারী সেজে বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে গিদালের উত্থাপিত গানের সাথে দোয়ার ধরে। মুলত গানের স্থায়ী অংশটুকু তারা গেয়ে থাকে। এদেরকে বলে ছোকড়া। এই ছোকড়ার দল শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক ধরণের বিশেষ নৃত্যের সাথে গানে অংশ নিয়ে থাকে। তারা প্রদক্ষিণ করে বসে থাকা বাদ্যযন্ত্র ধারি শিল্পীদের চার পাশে। আমাদের মতো রক্ষণশীল দেশে এক সময় মেয়েদের এই সব গানে অংশ গ্রহণ একদম ছিল না। পঞ্চাশ বছর আগে গ্রামে তো এটা কল্পনাও করা যেতো না। ফলে মেয়েদের অভিনয় ছেলেদেরকেই করতে হতো। তবে পশ্চিম বঙ্গের কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, আসামের ধুবড়ী ও গোয়ালপাড়া জেলায় মেয়েরাই অংশ গ্রহন করে থাকে এই সব ক্ষেত্রে। সেখানে সম্পূর্ণ মেয়েদের দ্বারা পরিচালিত দলও রয়েছে। বরং ছেলেদের ভুমিকায়ও অনেক সময় মেয়েরাই পারফর্ম করে থাকে। এই ছেলেদেরকে শিল্পী বলা হয়না, বলা হয় ছোকড়া। যদিও তারাও এক এক জন এক একটি শিল্পী। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, এক সময় গ্রামাঞ্চলে ছিল ঘাটুর গান, ছিল লেটুর গান ইত্যাদি। এসব গানে ছেলেদেরকেই অভিনয় করতে হতো। বিনোদনের জন্য এর বিকল্প কিছু ছিল না। প্রসঙ্গ যখন এসেই গেলো, তবে এই গানগুলো সম্পর্কে পরে দুএকটি কথা বলা যাবে। যা হোক, কুশান পালার মূল শিল্পী দাঁড়িয়ে গান করেন।
বাকি দোয়ারী ও শিল্পীগণ কণ্ঠ দিয়ে কোরাস গান তৈরী করেন। মুল শিল্পীকে আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় গিদাল । এই গিদাল একাই কাহিনীকে বর্ণনা করে নানা ঘটনার বিস্তার করে রসাত্মক উপস্থাপনায় এগিয়ে নিয়ে শেষ করেন পালা। গিদাল হয় অত্যন্ত দক্ষ। তিনি কখনো সংগীতে, কখনো সংলাপে, আবার কখনো কাব্যিক উপস্থাপনায় বা অভিনয়ের মাধ্যমে কাহিনীকে রসময় করে তুলে ধরেন। তার অসাধারণ নৈপুণ্যতা দর্শকদেরকে বিমূহিত করে রাখে। সঙ্গীতের মাঝে মাঝে কাহিনী সংশ্লিষ্ট নয় এমন আকর্ষণীয় গানও পরিবেশন করেন। গানে গানে কাহিনী বলার সময় বসে থাকা শিল্পীরা কন্ঠ দিয়ে কোরাস তৈরী করে। অনেক সময় একটি ভিন্ন গানের স্থায়ি অংশটি কোরাসে যুক্ত করে গাওয়া হয়। মুল গানটি শুধু গিদাল গেয়ে থাকেন। গিদালের হাতে থাকে বেণা। এই বেণা হলো ছোট আকারের একটি বাটির মতো। একটি লম্বা বাঁশের কাঠির সংগে বাটিটি যুক্ত করা থাকে। বাটিটি তৈরী হয় সাধারণত মাটি ,নারকেলের মালাই বা স্টিল দ্বারা। তাতে চামড়া দিয়ে ছাওনি দেওয়া হয়। বেণার মাথায় থাকে দোতারার মতো একটা মযূর আকৃতির অংশ। তাতে আগা হতে বাটিটি পর্যন্ত তার সংযোজিত থাকে। গিদালের ডান হাতে থাকে ধনুকের মতো বাঁকা একটা কাঠি, যাকে বলা হয় চড়। এই চড়ের মাথা হতে গোড়া পর্যন্ত থাকে ঘোড়ার লেজের চুল- যা দিয়ে বেণার তারে তারে ঘর্ষণ দিতে হয়। দেখতে বেহালার মতো যন্ত্রটি বেশ মধুর একটা সুর তুলে থাকে। এই বেণা শুধু বাদ্য যন্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হয় না। গিদালের উপস্থাপনার সময় কখনো ঘাড়ে করে গদা, আবার কখনো তীর-ধনুক ছোড়ার মতো অভিনয় ,আবার কখনো বা লাঠি ইত্যাদি হিসাবে ব্যবহার করে। অবশ্য দলে অন্যান্য শিল্পীদের হাতেও থাকে বেহালা ,হারমোনিয়াম, বাঁশী, দোতরা, করতাল ঢোল তবলা মৃদঙ্গ ইত্যাদি। সাধারণত রামায়ণের কাহিনী নির্ভর গান নিয়েই হয় কুশান পালা।
কুশান শব্দটি এসেছে কু বা মন্দ কোন কিছুকে শান দিয়ে ধারালো করা থেকে। ভোঁতা একটি বিষয়কে দুরে ঠেলে দিয়ে ধারালো করে দেয়াকে বুঝাতে এই নাম। আবার ভিন্ন মতে , সীতা দেবীর পুত্র লব-কুশকে নিয়ে যে কাহিনী গাওয়া হয় তাকেই কুশান পালা হিসাবে অভিহিত করা হয় । কুশান হলো গান নির্ভর একটি নাট্য পালা। ভাওয়াইয়ারই একটি নাট্যরূপ। অনেকের মতে অদ্ভূত রামায়ণের কাহিনী হতেই কুশান গানের সৃষ্টি। অদ্ভুত রামায়ণের স্রষ্টা হলেন অদ্ভূতাচার্য্য। মূলত লব-কুশের কাহিনী। আধুনিকতার সংগে প্রতিযোগীতায় হারিয়ে যেতে বসেছে এই গান।
( চলবে )