বঙ্গনিউজঃ রেকর্ড ভেঙেছে সিলেট-সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতি। বন্যার পূর্বাভাস ছিল। নদীর পানির উচ্চতাও বাড়ছিল গত কয়েকদিন ধরে। কিন্তু গতকাল নাগাদ এমন পরিস্থিতি হবে- তা ভাবতেই পারেনি সিলেট ও সুনামগঞ্জের মানুষ। টানা বৃষ্টি, ভারত থেকে আসা উজানের ঢল আর নদীর পানির অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হার মানিয়েছে সকল প্রস্তুতিকে। স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিরা বলছেন, অতীতে তাদের দেখা সব বন্যার চেয়ে ভয়াবহ এবারের পরিস্থিতি। ভারতের গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা চেরাপুঞ্জিতে ২৪ ঘণ্টায় ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, যা জুন মাসে ১২২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আর তিনদিনে সেখানে প্রায় আড়াই হাজার মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এটিও গত ২৭ বছরের মধ্যে তিনদিনে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের রেকর্ড। ওই বৃষ্টির পানি ঢল হয়ে এসেছে সিলেট-সুনামগঞ্জে।
সুনামগঞ্জ শহরে এখন একতলা কোনো বাড়িতে পানি উঠতে বাকি নেই। সদরের পাশাপাশি দোয়ারাবাজার, ছাতক, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, জামালগঞ্জ ও জগন্নাথপুর উপজেলা ভাসছে বন্যার পানিতে। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলার বেশিরভাগ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। জৈন্তাপুর ও কানাইঘাট উপজেলারও বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত। পানি বাড়ছে সিলেট সদর, দক্ষিণ সুরমা, জকিগঞ্জ ও বিশ্বনাথ উপজেলায়।
এ অঞ্চলের সবগুলো নদীর পানিই বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে সিলেটের সঙ্গে সুনামগঞ্জের যোগাযোগ। ক্রমশ বাড়ছে পানির উচ্চতা। দুর্ভোগ বর্ণনাতীত। গলা পানিতে ভেসে থাকা মানুষগুলো খড়কুটো ধরে ভেসে থাকার প্রাণান্তকর চেষ্টা করছে। উদ্ধারকর্মীদের নৌকা দেখলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছে আটকে পড়া মানুষ। পানিতে ভেসে গেছে বাজার ঘাট। ঢলের পানি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে স্থানীয় মুদি দোকানগুলো। একদিকে আশ্রয়ের খোঁজ। অন্যদিকে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে খোলা আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ঠাঁই মিলছে না। এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় অনেক স্কুলে আশ্রয়কেন্দ্র চালু করা সম্ভব হয়নি। সিলেট শহরের প্রধান রাস্তা থেকে শুরু করে অলিগলি তলিয়ে গেছে পানিতে। সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দর তিনদিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বন্ধ হয়েছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে রোববার থেকে শুরু হতে যাওয়া এসএসসি পরীক্ষাও। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সিলেট বিভাগের ১৬ উপজেলা। বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় সুনামগঞ্জের দু’টি উপকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। যেকোনো সময় বন্ধ হতে পারে সিলেটের কুমারগাঁও উপকেন্দ্র।
বিদ্যুৎ না থাকায় মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্কও কাজ করছে না। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে ইন্টারনেট সেবাও। ফলে আক্রান্ত এলাকার বাসিন্দারা দেশে ও দেশের বাইরে থাকা স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় স্বজনরা। উদ্ধার অভিযানে সিলেট ও সুনামগঞ্জের ৮ উপজেলায় নামানো হয়েছে সেনাবাহিনী। চলছে ত্রাণ বিতরণের প্রস্তুতি। আইএসপিআর-এর সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সিলেট এবং সুনামগঞ্জ জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার প্রেক্ষিতে দুই জেলার ৮ উপজেলায় গতকাল সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। সিলেট জেলার সদর, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ এবং সুনামগঞ্জ জেলার সদর, জামালগঞ্জ, দিরাই, দোয়ারাবাজার ও ছাতক উপজেলায় মানবিক বিপর্যয় ঠেকাতে কাজ করছে সেনাবাহিনী। এছাড়াও, সুনামগঞ্জের খাদ্য গোডাউন রক্ষা এবং কুমারগাঁও পাওয়ার স্টেশনে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সেনাবাহিনী আক্রান্ত এলাকায় মূলত ৫টি কাজে নিয়োজিত রয়েছে। পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নেয়া; বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র নির্বাচন এবং উদ্ধারকৃত ব্যক্তিবর্গের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা; চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করা; খাদ্য গোডাউন, পাওয়ার স্টেশন এবং অন্যান্য স্থাপনা রক্ষায় বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করা এবং সীমিত পরিসরে খাদ্য এবং সুপেয় পানি সরবরাহ করা।
বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে দেশের উত্তরাঞ্চলেও। তিস্তা, ধরলা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে আশপাশের বেশ কয়েকটি জেলা। কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, বগুড়া, নেত্রকোনার হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সিলেটে ঢলে ভেসে যাচ্ছে ঘর এমন পরিস্থিতি হবে কল্পনা করতে পারেননি কেউ। উজান থেকে ধেয়ে আসা ঢলে তলিয়ে গেছে সিলেট। ঘরের চালের উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বানের পানি। ঢলের তোড়ে ভেসে যাচ্ছে ঘরবাড়ি। আর্তনাদ করছে মানুষ। ভারী হয়ে উঠেছে পরিবেশ। বৃষ্টি থামছে না। অঝোরধারায় হচ্ছে। আশ্রয় কেন্দ্রে ঠাঁই নেই। একটু আশ্রয়ের আশায় পরিবার নিয়ে ছুটছে মানুষ। অভুক্ত অবস্থায় কাটছে দিন। জীবন বাঁচানোর জন্য প্রাণান্তর চেষ্টা। ঢলের কারণে ব্যাহত হচ্ছে উদ্ধার তৎপরতাও। বাড়িঘর থেকে হাজার হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে সড়কে। বৃষ্টির মধ্যে খোলা আকাশের নিচে তারা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এই মুহূর্তে সিলেটের মানুষ কঠিন সময় পার করছেন।
বিদ্যুৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা কাটছে না। নগরের কুমারগাঁওয়ে বিদ্যুতের ৩৩ হাজার কেভি সঞ্চালন লাইনে পানি ঢুকেছে। ছুটে গেছেন সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যরা। সঙ্গে সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীও। বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে দিনভর চলেছে প্রাণপণ চেষ্টা। ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে স্পর্শ করতে শুরু করেছে বন্যার পানি। বিকাল থেকে ফ্লাইট ওঠা-নামা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বন্যার কারণে বিদ্যুৎ নেই সিলেট জেলার অর্ধেক এলাকায়। খাবার সংকট তীব্র। গত দু’দিন ধরে অভুক্ত ৫টি উপজেলার বেশির ভাগ। রাত কাটে আতঙ্কে। এমন অবস্থা দীর্ঘ হলে সিলেটে মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। বৃষ্টি; সঙ্গে উজানের ঢল। দুটোই থামছে না। পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন সবাই। জীবন নিয়ে চলছে লড়াই। জেলার সীমান্তবর্তী কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, সিলেট সদর, জৈন্তাপুর ও কানাইঘাটের পরিস্থিতি ভয়াবহ। অন্তত ৫ লাখ মানুষ পানিবন্দি। উজানের ঢলের কারণে স্থানীয়রা উদ্ধার কাজ চালাতে পারছেন না। মানুষের আর্তনাদ শুনে কেউ এগিয়ে যাওয়ার সাহস পাচ্ছেন না। বৃহস্পতিবার রাতে গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জের প্রশাসনের কর্মকর্তারা কয়েকটি স্থানে উদ্ধার কাজ চালিয়েছেন। আটকা বহু মানুষ। কেউ ঘরের চালে, কেউ মাচায়, আবার কেউ গাছের উপরে অবস্থান নিয়েছেন।
গবাদি পশুর আশা ছেড়েই দিয়েছেন। চারটি উপজেলায় আশ্রয় কেন্দ্রেও ঠাঁই হচ্ছে না। সবখানেই গাদাগাদি করে অভুক্ত অবস্থায় রয়েছে মানুষ। কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাটের অনেক স্থানে আশ্রয়কেন্দ্র পর্যন্ত যেতে পারছে না সাহায্যকারী টিম। উদ্ধারের জন্য নৌকার সংকটও তীব্র। বড় নৌকা ছাড়া যাওয়াও যাচ্ছে না। এই অবস্থায় গতকাল সকালেই সিলেটের জেলা প্রশাসন থেকে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা চাওয়া হয়। তাৎক্ষণিক সাড়া দিয়েছেন সিলেটের ১৭ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল হামিদুল হক। দুপুরের আগেই তিনি ডিভিশন হেড কোয়ার্টারে প্রেস ব্রিফিং করেন। জানান- সিলেট ও সুনামগঞ্জের ৮ উপজেলায় ৭ ব্যাটেলিয়ন সেনাবাহিনী নামানো হয়েছে। তাদের প্রথম কাজ হচ্ছে; বন্যায় আটকে পড়া মানুষজনকে উদ্ধার করা। এরপর খাবার, চিকিৎসা, শেল্টার হোমে নিয়ে যাওয়া এবং বিদ্যুৎসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রক্ষা ও সুনামগঞ্জের চালের গুদাম রক্ষা করা। দুপুরের পরই সেনা সদস্যরা মাঠে কাজ শুরু করে। কখনো সাঁতরে, কখনো পানি ডিঙিয়ে তারা উদ্ধারে নেমেছেন আটকে পড়াদের। সেনা সদস্যরা মাঠে নামায় কিছুটা স্বস্তি। কিন্তু প্রবল বেগে উজানের ঢল নামার কারণে স্বস্তি নেই। এমনি করে ২০০৪ সালে নেমেছিল উজানের পানি। এবারো নামছে।
এতে করে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। মানুষজন হয়ে পড়ছেন পানিবন্দি। সিলেট সদর ও বিশ্বনাথের চারটি ইউনিয়নের অবস্থা ভয়াবহ। মানুষ ঘরের চালে আশ্রয় নিয়েছেন। ঢলের তোড়ে সিলেট সদরে এক যুবক পানিতে তলিয়ে গেছে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আঘাত হেনেছে বন্যার পানি। হলের ভেতরে আটকা পড়েছে হাজারো শিক্ষার্থী। কোমর পরিমাণ পানিতে ডুবে আছে ক্যাম্পাস। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সকালে জরুরি সিন্ডিকেট সভা করেছে। এরপর আগামী ২৫ শে জুন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ রাখা হয়েছে। হলের শিক্ষার্থীদের খাবার ও নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ভিসি অধ্যাক ফরিদ উদ্দিন। সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ সড়ক যোগাযোগ ২ দিন ধরে বন্ধ। কোমর পরিমাণ পানিতে তলিয়ে গেছে কোম্পানীগঞ্জ সড়ক। সিলেট জাফলং সড়কের জৈন্তাপুরের ৪নং এলাকা দিয়ে প্রবল বেগে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ওই এলাকার অনেক বাড়ি ঢলের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার দু’টি ঘটনা নাড়া দিয়েছে সবাইকে। ভিডিও হয়েছে ভাইরাল। এর মধ্যে কোম্পানীগঞ্জের একটি বাড়ি ধলাই নদীর ঢলের তোড়ে ভেসে গেছে। পরিবারের সদস্যরা দৌড়ে ডাঙায় উঠতে পারলেও ওই পরিবারের কোনো কিছুই অবশিষ্ট থাকেনি।
তাণ্ডব চালাচ্ছে প্রলয়ঙ্করী ধলাই। অপর ঘটনাটি ঘটেছে জৈন্তাপুরের সারি নদীর তীরবর্তী এলাকায়। সেখানেও গতকাল এক মিনিটের মধ্যে নদীগর্ভে তলিয়ে গেছে একটি বসতবাড়ি। নিশ্চিহ্ন হয়েছে ওই বাড়ি। ঢলের তোড় বেশি থাকায় নদী তীরবর্তী মানুষজন সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ সড়ক ও সিলেট-জাফলং সড়কে এসে অবস্থান নিয়েছে। হাজারো মানুষ বৃষ্টির মধ্যে জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছেন সড়কে। ওই দুই সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ। বিদ্যুৎ নেই গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর ও সিলেট সদরে। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে বিদ্যুতের সাব স্টেশনগুলো। কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট সদরে কোমর পানি। প্রশাসনের কর্মকর্তারাও পানিবন্দি। এক স্থান থেকে অন্যস্থানে তারা যেতে পারছেন না। ফলে থমকে গেছে সিলেটের জীবনযাত্রা। তীব্র খাদ্য সংকটের কারণে হাহাকার করছে মানুষ। এই মুহূর্তে শুকনো কিংবা রান্না করা খাবার তাদের কাছে পৌঁছানো হচ্ছে চ্যালেঞ্জ। কিন্তু সবাই যেখানে বন্যায় আক্রান্ত; কে নেবে কার খবর- এমন পরিস্থিতি চলছে সিলেটজুড়ে। ফ্লাইট ওঠা-নামা বন্ধ: বন্যার পানি রানওয়ের কাছাকাছি এলাকায় চলে আসায় সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্লাইট ওঠা-নামা বন্ধ করা হয়েছে। বিকাল ৪টায় বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ এ ঘোষণা দেন। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের চর্তুদিকে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। এতে আশপাশের এলাকার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় আশপাশের এলাকার কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বিমানবন্দরের ম্যানেজা হাফিজ উদ্দিন আহমদ জানিয়েছেন, এখনো রানওয়েতে পানি ঢোকেনি। তবে কাছাকাছি এলাকায় চলে আসার কারনে বিকাল থেকে ফ্লাইট ওঠা-নামা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বিদ্যুৎ স্বাভাবিক রাখতে প্রাণান্তকর চেষ্টা: ভয়াবহ বন্যার কবলে সিলেট। শহরতলীর কুমারগাঁওয়ে বিদ্যুতের ৩৩ হাজার কেভি স্টেশনে ঢুকে পড়েছে পানি। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকার কারণে বিদ্যুৎ স্টেশন বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সকালেই এ স্টেশনে ছুটে যান সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। দুপুরের দিকে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার কোরের একটি টিমও ওখানে গেছে। তারা সিলেটের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে কাজ করছেন। মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী জানিয়েছেন- সেনাবাহিনীর সদস্যরা, বিদ্যুতের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এবং আমরা মিলে সিলেটে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে কাজ করছি। বিদ্যুৎহীন হয়ে গেলে সিলেটের মানুষের সমস্যা অন্ত থাকবে না। এ কারণে বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ জরুরি সেবাগুলো যাতে স্বাভাবিক থাকে সে জন্য কাজ করা হচ্ছে। এদিকে বন্যাকবলিত এলাকায় এরই মধ্যে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। নগরের উপশহরের বিদ্যুতের সাব স্টেশনে পানি ঢুকেছে। এ ছাড়া কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, সিলেট সদরসহ কয়েকটি এলাকায়ও বিদ্যুতের স্টেশন পানিতে তলিয়ে গেছে। সিলেটের ১৭ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল হামিদুল হক জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে দুপুর থেকে সেনাবাহিনীর একটি টিম কাজ করছে। এর বাইরে খাদ্য গুদাম রক্ষায়ও কাজ শুরু হয়েছে।
জকিগঞ্জে ফের বন্যা, ভাঙা বাঁধ দিয়ে ঢুকছে পানি জকিগঞ্জ উপজেলায় প্লাবিত হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। ইতিমধ্যে সুরমার ডাইকের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে বারহাল ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। অধিকাংশ বাড়িঘরে পানি উঠে ঘর ছাড়া হচ্ছে মানুষ। বারহাল ইউপি’র চেয়ারম্যান জানান, সুরমা ডাইকের কয়েকটি স্থানের ওপর দিয়ে পানি লোকালয়ে প্রবল বেগে প্রবেশ করছে। নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে, গ্রামীণ সড়কগুলো ডুবে গিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। খেশরপুর, মন্তইল, পাচালি, বাটইশাইল, বালিটেকা, নিদনপুর, ফতেহপুর, খিলগ্রাম, পইল, সমসখানি, আখাবসহ বিভিন্ন গ্রামের মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। বন্যা কবলিত এলাকায় নৌকার অভাবে চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। সুরমা ডাইকের নূরনগর, উত্তর খিলগ্রাম, বারাকুলি, পুঁটিজুড়ি, নোয়াগ্রাম, নিজগ্রাম, কচুয়া এসব স্থানের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। কাজলসার ইউনিয়নের নোয়াগ্রামে গত বন্যার ভাঙন দিয়ে হু হু করে সুরমার পানি ঢুকে বেশ কয়েককটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বারঠাকুরী ইউনিয়নের পিল্লাকান্দি গ্রামের পুরাতন ভাঙন দিয়ে কুশিয়ারার পানি ঢুকছে লোকালয়ে। বরাক, সুরমা, কুশিয়ারার মিলনস্থল আমলসীদ পয়েন্ট রয়েছে ঝুঁকিতে, যে কোনো সময় ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
গত ৪৮ ঘণ্টা থেকে একটানা বৃষ্টি হচ্ছে, থামছে না বৃষ্টি। সুরমা, কুশিয়ারা বেষ্টিত সীমান্তবর্তী জকিগঞ্জের মানুষ উদ্বেগ, উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন। সুরমা, কুশিয়ারার পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ঝুঁকিতে রয়েছে সুরমা, কুশিয়ারার বেশ কয়েকটি বেড়িবাঁধ। কুশিয়ারার পানি আরও একহাত বৃদ্ধি পেলে পুরো উপজেলা পানিতে তলিয়ে যাবে- এমনটাই বলছেন সচেতন মহল। বারহাল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোস্তাক আহমদ চৌধুরী জানান- সদ্য সমাপ্ত বন্যার চেয়ে এবারের বন্যা ভয়াবহ, বারহাল ইউনিয়নের সবক’টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। তিনি জানান ৬টি সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আতাউর রহমান জানিয়েছেন, বন্যা কবলিত হওয়ার খবরটি কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। উপজেলা নির্বাহী অফিসার একেএম ফয়ছল জানান, বারহাল ও কাজলসার ইউনিয়ন ইতিমধ্যে বন্যায় আক্রান্ত। জেলা প্রশাসক ২০ টন চাল ও নগদ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। বন্যার্ত মানুষের মাঝে বিতরণের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সুনামগঞ্জে উদ্ধার অভিযানে সেনা মোতায়েন সুনামগঞ্জ জেলায় বন্যার পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এই বন্যা অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। টানা কয়েকদিনের ভারী বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে জেলার কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। সবক’টি উপজেলার গ্রামের প্রতিটি ঘরে এখন হাঁটু থেকে কোমর পানি। বৃহস্পতিবার রাত থেকে গ্রামের নারী-পুরুষ, শিশু বৃদ্ধরা পানিবন্দি হয়ে আটকা পড়ে রয়েছেন। দ্রুত তাদের উদ্ধার করে উঁচু স্থান বা আশ্রয়কেন্দ্রে না নিলে বড় দুর্ঘটনার সম্ভাবনা রয়েছে। পানির উচ্চতা ক্রমশ বাড়ছে। ফলে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। এ অবস্থায় বন্যাকবলিতদের উদ্ধারে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।
ওদিকে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেছে সেনাবাহিনী। নৌকা দিয়ে বাড়িঘর থেকে পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয় আসছেন সেনা সদস্যরা। গতকাল দুপুর থেকে উদ্ধার কাজ শুরু হয়েছে। গোলাবাড়ী গ্রামের খসরু মিয়া জানিয়েছেন, একদিকে বন্যার পানি হু হু করে বাড়ছে অন্যদিকে হাওরের প্রবল ঢেউয়ের আঘাতে বাড়িঘর তছনছ হয়ে যাচ্ছে। মাওলানা নুরুল ইসলাম জানান, ঘরে হাঁটু পানি। পানির মধ্যেই সরারাত ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে পার করেছি। গরুগুলো পানির মধ্যেই দাঁড়িয়ে আছে। এগুলো উদ্ধার করে কোথাও নিয়ে যাবো সে সুযোগটুকু পাচ্ছি না। উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আবুল হোসেন খান বলেন, গত ২৪ ঘণ্টা ধরে একনাগাড়ে বৃষ্টি, বাতাস ও বজ্রপাতের বিকট শব্দ হচ্ছে। এর আগে অনেক বন্যা হয়েছে, তবে এবারের মতো বন্যা এর আগে কখনো দেখিনি। বালিয়াঘাট গ্রামের ইসলাম উদ্দিন জানান, বন্যার পানিতে রান্নার ঘরসহ বসতঘর ডুবে গেছে। গত রাত থেকে চুলায় আগুন নেই। কিছু শুকনো খাবার ছিল তা দিয়ে বাচ্চাদের খেতে দিয়েছেন। তারা না খেয়ে পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। এদিকে সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে সারা দেশের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। গত দুইদিন ধরে জেলা সদরের সঙ্গে উপজেলা সদরের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। তাহিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগসহ কয়েকটি হাসপাতালের নিচতলা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। গত দুইদিন ধরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, জামালগঞ্জ, মধ্যনগরসহ সবক’টি উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে রয়েছেন। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জহুরুল ইসলাম জানান, সুরমা নদীর সুনামগঞ্জ পয়েন্টে ২০২০ সালের বড় বন্যার সময় পানির উচ্চতা ছিল বিপদসীমার ৭০ সেন্টিমিটার উপরে। গত বৃহস্পতিবার সেটি অতিক্রম করেছে। বিপদসীমার ৭৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে বইছে সুরমার পানি। মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জিতেও গত ২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড পরিমাণ ৬৭৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। সুনামগঞ্জে হয়েছে ১৮৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত। সিলেট আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী বলেছেন, আগামী ১০ দিনের আবহাওয়ার পূর্বাভাসে দেখা গেছে, একইভাবে ৪ দিন বৃষ্টি হবে। এ কারণে সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেছেন, বন্যা পরিস্থিতির ভয়াবহতা অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে বন্যা তথ্যকেন্দ্র খোলা হয়েছে। ছাতকে ১৭টি, দোয়ারাবাজারে ১৬টি এবং সুনামগঞ্জ সদরে ১০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। বন্যা দুর্গতদের মধ্যে বাড়িঘরে থাকার অনুপযোগীদের সেনা সদস্যরা আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসছেন।