বঙ্গ-নিউজ: এই কাবাডি বা হাডুডু খেলা সম্পর্কে যৎকিঞ্চিত বর্ণনা দেয়া প্রয়োজন মনে করছি । কারণ বিলুপ্ত প্রায় এই খেলাটি নতুন প্রজন্মের অনেকেই হয়তো নাও চিনতে পারেন। উল্লেখ্য যে,এই খেলাটি আমাদের জাতীয় খেলা। অনেকেই হয়তো বিসিএস গাইডে পরীক্ষা পাশের জন্য অনেক কষ্ট করে মুখস্ত করে থাকে এই খেলার বর্ণনা।
আধুনিকতার ছোঁয়া ও কালের বিবর্তনে মহাকালের পাতা থেকে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ খেলা। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা গুলো আজ বিলুপ্ত প্রায়। শৈশবে যেসব খেলাধুলায় দিন কাটিয়েছেন আজকের বয়োবৃদ্ধরা , তারাও এখন ভুলতে বসেছেন সেসব খেলার নাম। এ খেলাগুলোর মধ্যে বর্তমানে ফুটবল খেলার কিছু প্রচলন থাকলেও প্রায় সবগুলো খেলা হারিয়ে গেছে।
সাধারণত হা-ডু-ডু খেলার মাঠের কোনো সুনির্দিষ্ট মাপ থাকে না। খেলায় অংশ গ্রহণ কারীরা যে জায়গায় খেলা হবে তার আকার বিবেচনা করে নিজেরা আলোচনা করে চারদিকে দাগ দিয়ে খেলার মাঠের সীমানা ঠিক করে নেয়। তবে পরিমাণের দিক থেকে মাঠ যত বড়-ছোটই হোক, এর আকৃতি হয় আয়াতকার। মাঝখানে দাগ দিয়ে মাঠকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়। প্রতিভাগে একেকটি দল অবস্থান নেয়। অন্যদিকে কাবাডি মাঠের আকার হয় দৈর্ঘে ১২.৫০ মিটা আর প্রস্থে ১০ মিটার। নিয়ম অনুসারে এক পক্ষের একজন খেলোয়ার অপর পক্ষের কোর্টে হানা দেয়। এ সময় সে শ্রুতিগোচর ভাবে হা-ডু-ডু বা কাবাডি কাবাডি কাবাডি বা যে কোন ধরনের শব্দ করতে করতে অন্য পক্ষের যে কোন একজন বা একাধিক জন খেলোয়ারকে ছুঁয়ে ফিরে আসার চেষ্টা করে। ওই পক্ষের চেষ্টা থাকে সবাই মিলে বা এক জনে আক্রমণকারী খেলোয়ারকে জাপটে ধরে আটকে রাখা। যদি ওই খেলোয়ার দম না ছেড়ে নিজের কোর্টে ফিরে আসতে পারে ,তাহলে তার দল পয়েন্ট পায় আর যদি আটকে থাকা অবস্থায় খেলোয়ারটির দম ফুড়িয়ে যায়, তাহলে বিপক্ষ দল পয়েন্ট পায়। এই ভাবে শেষ খেলোয়ারটি পর্যন্ত খেলা চলতে থাকে।
এই হা-ডু-ডু বা কাবডি শুধু বাংলাদেশেরই জাতীয় খেলা নয়, প্রতিবেশি দেশ ভারতের ছয়টি রাজ্যের জাতীয় খেলা এটি। রাজ্যগুলো হলো : তামিলনাডু, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, বিহার ও পাঞ্জাব। অবশ্য বিভিন্ন প্রদেশে খেলাটির ভিন্ন ভিন্ন নাম রয়েছে। তামিলনাডুতে এ খেলাটি কবাডি, সাডুগুডি,গুডুগুডু,পালিঞ্জাডুগুডু ও সাডুগুডাত্থি নামে পরিচিত।
ব্যক্তিগত ও দলগতভাবে শত্রুপক্ষের আক্রমণ ঠেকিয়ে দেওয়া এবং সাথে সাথেই পাল্টা আক্রমণের কৌশল চর্চা করতে গিয়েই সম্ভবত এ খেলার উদ্ভব। এ খেলায় সফলতার শর্ত হচ্ছে শারীরিক ও মানসিক ক্ষিপ্রতা,পেশীর ক্ষিপ্রতা, ফুসফুসের শক্তি, ও সহনশীলতা, দ্রুত চিন্তা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ও তা প্রয়োগের সামর্থ। সেই সঙ্গে প্রতি পক্ষের কৌশল ও মনোভাব অনুধাবনের যোগ্যতাও গুরুত্বপূর্ণ।
হা-ডু-ডু বা কাবাডিকে কেনো জাতীয় খেলার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, সরকারি কোনো দলিলে এর ব্যাখ্যা নেই। এমনকি এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়াতেও এর কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে দুটি বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে এ খেলাটিকে জাতীয় খেলার মর্যাদা দেওয়া হতে পারে। গ্রাম নির্ভর এই দেশে এক সময় ব্যাপক ভাবে হা-ডু-ডু খেলার প্রচলন ছিল। গ্রামঞ্চলে এটিই ছিল সব চেয়ে জনপ্রিয় দলগত খেলা। শুধু স্বীকৃত খেলার মাঠ নয়,গ্রামের পাশের পতিত জমি, বালুচরসহ যে কোনো সুবিধাজনক জায়গায় দাগ কেটে কোর্ট বানিয়ে তরুণরা এই খেলা শুরু করে দিতো। তরুণরা তখন খেলার পাশাপাশি এটিকে এক ধরনের শরীর চর্চা ও শক্তিমত্তার পরীক্ষা হিসেবে নিত। অন্যদিকে গ্রামবাসী দলবেঁধে এই খেলা উপভোগ করতো। দেশজুড়ে খেলাটির এই জনপ্রিয়তার কারণে এটিকে জাতীয় খেলার মর্যাদা দেওয়া হয়ে থাকতে পারে।
এখন আর সে সব নেই। মনে হয় বাংগালীদের ঐতিহ্য এ সব খেলার নামও সবাই ভুলে যেতে বসেছে। এখন সব মোবাইল নিয়েই ব্যস্ত, নিজেদেরকে দলগত ভাবে নয়, একাকীত্বে ডুবিয়ে দিচ্ছে। শহুরেদের মতোই সারাদিন মোবাইলে হাসে,মোবাইলে কাঁদে, মোবাইলে কথা বলে , মোবাইলেই আবেগ উচ্ছাস প্রকাশ করে। মোবাইল নিয়ে মত্ত থাকার কারণে কেহ কিছু জানতে চাইলে উত্তর আসে অনাকাঙ্খিত রকমের। মায়ে জিজ্ঞেস করে , “ এখন খাবে নাকি “ ? উত্তর আসে “ না আজ কোন ক্লাস নেই”।
আজকাল খেলার পরিবেশও অনুপস্থিত। লোক সংখ্যা বেড়েছে। যেখানে অনেক পরিবারেরই জমি ছিল একশ দু’একশ বিঘা , সেটি এখন আর একান্নভুক্ত নেই, হয়েছে বহুধা বিভক্ত। জমি হয়েছে একাধিক টুকরো। এখন সবাই শুধু আপনারে নিয়েই বিব্রত, ভুলে গেছে “ আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসিনি কেহ অবণী পরে”- এই কথাটি। প্রায় প্রতিটি আবাদি জমির মাঠে হয়েছে এক একটি বাড়ি। সংকুচিত হয়ে আসছে আবাদি জমি, মাঠ। স্বাধীনতা কালে শুনেছি “ সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না” -এই কথাটি, - বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন। এখন সেই মানুষের সংখ্যা প্রায় সতের কোটি। জমি আমাদের ঠিকই আছে, যেমনটি ছিল আগে। কিন্তু ফাঁকা জমি প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে। চলবে-