রবিবার ● ১২ জুন ২০২২

সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ১৬ : স্বপন চক্রবর্তী

Home Page » সাহিত্য » সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ১৬ : স্বপন চক্রবর্তী
রবিবার ● ১২ জুন ২০২২


স্বপন কুমার চক্রবর্তী

বঙ্গ-নিউজ: প্রসঙ্গক্রমে আরো উল্লেখ করা যায়, পার্শবর্তী এলাকার এটি নাটকের কথা। এলাকাটির নাম ধওলাই। সেখানে একটি নাটক হচ্ছে। সম্ভবত নাটকটির নাম “ ঘুমন্ত পৃথিবী”। উক্ত নাটকের মাঝখানে আমি একটি সংবাদ পাঠ করে ছিলাম। স্বাধীনতা যুদ্ধের অব্যবহিত পরের ঘটনা হওয়ায় আকাশ বাণী, আকাশবাণী কোলকাতা, বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকা ছিল প্রতিটি মানুষের নিকট প্রিয় ও পরিচিত নাম। তারই অনুকরণে প্যারোডি সংবাদ তৈরী করে আমি নিজেই সেটা পাঠ করে ছিলাম। তখন উল্লেখযোগ্য ও নাম জানা সব সংবাদ পাঠক–পাঠিকাদের মধ্যে ছিলেন অনিল চট্টোপাধ্যায়, নীলিমা সান্যাল, ইভা নাগ ও কোলকাতার বাগ্মী সংবাদ পাঠক ও পর্যালোচনাকারী দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। শ্যামল লোধ ছিলেন বিবিসির সংবাদ পাঠক। আমি তাদের অনুকরণে বিশেষ করে নীলিমা সান্যালের অনুকরনে সংবাদ পাঠ করেছিলাম। শ্রোতারা নিবিষ্ট্য চিত্তে শোনতে ছিলেন। মাইক্রোফোনে অর্ধ চন্দ্রাকারে লেখা ঝুলানো ছিল “ ধওলাই বেতার কেন্দ্র”। সংবাদের মাঝখানে ইচ্ছাকৃত ভাবে একটি ভুল সংবাদ পড়ে তারপর আবার বলেছি, ”মাফ করবেন, আমি আবার পড়ছি।” সংবাদের সব ছিল প্যারোডি। দইখাওয়ার বাজার কমিটির সভাপতিকে সবাই ”খেরবাড়ির” মওলানা সাহেব বলে ডাকতো। আমি বলেছিলাম দইখাওয়ার মেয়র জনাব খেরবাড়ির মাওলানা সাহেব। দইখাওয়া স্কুলের প্রধান শিক্ষক মহোদয়ে নাম কৃষ্ণ চন্দ্র রায়। আমি লিখেছিলাম দইখাওয়ার মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রী । শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন এবার থেকে ছাত্রদের সুবিধার দিকে খেয়াল রেখে নকল সুবিধাযুক্ত পাঠ্য সূচি প্রনয়ণ করবেন। লিখেছিলাম, ”দইখাওয়া বিমান বন্দর হতে ধওলাই গামী ৭০৭ একটি বোয়িং বিমানের উড্ডয়নের অব্যবহিত পর মধ্য আকাশে একটি মাছির সাথে কলিশন হয়। কলিশনে মাছিটি সম্পূর্ণ অক্ষত থাকলেও বিমানটির কটিদেশে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। তবে কোন হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। এতে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মেয়র জনাব খেড়বাড়ী গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনি অনতি বিলম্বে গণশত্রু এই মাছি নিধনের জন্য কঠোর নির্দেশ প্রদান করেছেন। অন্য একটি নাটকে বিখ্যাত সাংবাদিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং শব্দসৈনিক এম আর আক্তার মুকুলের অনুকরণে তারই লিখা ”চরমপত্র” থেকে পাঠ করেছিলাম। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এই অনুষ্ঠানটি অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পায়।
দইখাওয়াতে বা তার আশপাশে তখন কোন শহীদ মিনার ছিল না। অমর একুশের প্রভাতে নগ্নপায়ে কোন মিছিল হতো না। গ্রামাঞ্চলে এর কোন সংবাদ অনেকেই জানতো না। তখনও একুশে ফেব্রুয়ারী সরকারি ছুটি ঘোষিত হয়নি। প্রতি বছর এই দাবিতে শহরে মিছিল হতো। তাই আমি উদ্যোগ নিয়ে সত্তর সালে মিছিল বের করি। দইখাওয়ার চারদিকে প্রদক্ষিণ করি। শ্লোগান দিয়ে ছিলাম সরকারি ছুটি ঘোষণা করার জন্য। পরে সেই বছরই চিন্তা করি একটা শহীদ মিনার তৈরী করার জন্য। বেশ কিছু ছাত্র একত্রিত হয়ে চাঁদা তোলার সিদ্ধান্ত নেই। কারন আমরা যারা উদ্যোক্তা ,তারা সবাই ছাত্র। পকেট সবার গড়ের মাঠ। তাৎক্ষণিক রসিদ বই ছাপানোর ব্যবস্থা করি। সাথে ছিল আকরাম, ফজল, হামিদ, জগবন্ধু, সাবু, ওয়াজেদ,শাখাওয়াত, ওসমান, গজেন, আব্দুল হক,উমাপদ, তরনী ,গণেশ সুধীর সহ আরও অনেকে। সবার নাম এখন আর মনে নেই। আমাদেরকে অনেকেই চাঁদা প্রদান করেছিলেন স্বতস্ফুর্ত ভাবে। তবে টাকার অংক ছিল দুই টাকা পাঁচ টাকা, দশ টাকা। দুএকজন বোধ হয় বিশ টাকাও দিয়েছিলেন। আমরা খুব খুশি হয়ে সর্বোচ্চ চাঁদা দানকারীদের সম্বর্ধনা দিতেও ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলাম। কিন্তু পরে আর হলো না। এই ভাবে সর্বপ্রথম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে দইখাওয়াতে শহীদ মিনার তৈরী করেছিলাম। এই কাজে সহায়তা করেছিলেন মরহুম আনছার আলী মিয়া। সেই শহীদ মিনারটি এখন আর নেই। অন্য একটি বড় আকারের শহীদ মিনার সেখানে এখন স্থাপিত আছে।
নয় মাসের যুদ্ধ ও কষ্টের পর দেশ স্বাধীন হলো। তখন অনেক কিছুর মতো জাতীয় সংগীতও বদলে গেলো। ক্লাস শুরুর আগে, আগের মতোই অধিবেশনের ( পিটি-প্যারেড ) পর জাতীয় সংগীত গাইতে হবে। তখন হলো মহা সমস্যা। ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে কেহই এই জাতীয় সংগীত গাইবার আহ্বানে এগিয়ে এলো না। দীর্ঘ সময় সবাই রোদে দাঁড়িয়ে। শিক্ষকগণও কি করবেন বুঝতে পারছেন না। শুধু নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন। এখন আর গাওয়া যাবে না পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত। তার জন্য ত্রিশ লক্ষ লোক আত্মাহুতি দেয়নি, দুই লক্ষ মা-বোন সম্ভ্রম হারায় নি। পাকিস্তান আমলে সবাই লাইন ধরে অ্যাসেম্বলি শেষে ( সমাবেশ) দাঁড়ালে এক বা একাধিক ছাত্র প্রথমে গাইতো- ”পাক সার জমিন সাদ বাদ, কিশোয়ারে হাসিন সাদ বাদ। তু নিশানে আজমে আলী সান ,আর যে পাকিস্তান। মার কা যে আছিন সাদ বাদ। পাক সার জমিন কা নিজাম। কোওয়াতে অকোওয়াতে, আওয়াম”। ভুল কি শুদ্ধ জানতে পারতাম না। অর্থ কি তাও না। এখন পাকসার জমিন গাওয়া সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশে একেবারেই আইনসিদ্ধ নয়। তাই প্রিয় স্বাধীন মাতৃ ভুমি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত গাইতে সামনে এগিয়ে গিয়ে ছিলাম। সাথে সাথে আমাকে অনুসরণ করেছিল আমার সহপাঠি লাইলী। দুইজনেই গেয়ে ছিলাম – ”আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালো বাসি।” জানিনা সবাই কেন হাত তালি দিয়েছিল। কিন্তু পরে বিপদ হলো এই যে, প্রতিদিন আমাদের দুইজনকে জাতীয় সংগীত গাইতে হতো।

আমাদের এসএসসি পরীক্ষার ফেয়ারওয়েলের দিন আমরা একটি সিদ্ধান্ত নিলাম। তাহলো আমাদের স্কুলের দপ্তরী মোঃ মতি মিয়াকে একসেট পোশাক দিব,যা অনেকটা তাঁর ইউনিফর্ম হিসাবে ব্যবহারের জন্য হবে এবং তাঁর পেশাকের অভাবও দুর করবে। তাই তাঁকে টুপি ও কলারযুক্ত একটা পাঞ্জাবী ,পায়জামা এবং একটি রুমাল দিয়ে ছিলাম। সাথে আরও কিছু উপহার। সেই পাঞ্জাবীর পকেটে ডিজাইন এবং আমাদের ”পরীক্ষার্থী ব্যাচের” সাল উল্লেখ ছিল। ছিল কিছু জরির কাজও। এই ডিজাইনের কাজটি করেছিল লাইলী বেগম। লাইলীকে অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। সহপাটি বন্ধু লাইলী আমকে প্রতিটি ইতিবাচক কাজে সক্রিয় সহযোগীতা করেছিল। এই সামান্য উপহার পেয়ে মতি ভাই যারপর নাই খুশি হয়েছিল। আর একটি ঘটনা। আমাদের ব্যাচের দীনেশ চন্দ্র বর্মণ টাকার অভাবে ফরম ফিলাপ করেনি। সে করতে পাবরেনা বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তখনও আবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, পরীক্ষার্থী আমরা সকলেই এক সাথেই পরীক্ষা দেব। আমরা যে ক’জন পরীক্ষার্থী ছিলাম ,সবাই মিলে পাঁচ টাকা করে চাঁদা দিয়ে ছিলাম। আমার প্রতিটি সিদ্ধান্তের প্রতি কেহ কোন দিন আপত্তি করেনি। দীনেশ পরীক্ষা দিতে পেরেছিল এবং পাশও করেছিল। সে আজ বন্ধু দীনেশ আর ইহ জগতে নেই। তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।

তা যাক, আসল প্রসঙ্গে আবার ফিরে আসি।

দইখাওয়া আদর্শ কলেজের গেট। গেটটির বিশেষ বৈশিষ্ট হলো মনে হবে অনেকগুলো বই দিয়ে তৈরী ।
বর্তমানে আধুনিক ও নাগরিক জীবনের ছোঁয়া লেগে এই ভাওয়াইয়া গান অনেকটা আকর্ষণ হারাতে বসেছে। এখন যেখানে সেখানে ড্রাম বাজে বক্স বাজে। বাজে সিনেমার গান। ব্যান্ড সঙ্গীত এবং ডিজে, এমনকি বাজে অনেক হিন্দি ও বিদেশী গান। গ্রামীণ পরিবেশও সর্বত্র ব্যপক পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। বিদ্যুতের আলোয় ঝলমল করে গ্রাম। আছে ইন্টারনেট, রয়েছে ঘরে ঘরে রঙ্গিন টেলিভিশন। আছে প্রত্যেকের হাতে মোবাইল সেট,কম্পিউটার। চিকিৎসা সেবাও এখন দোরগোড়ায়। উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে গ্রামেই। একমাত্র গোতামারী ইউনিয়নেই ছিটমহলের প্রস্তাবিত কলেজসহ কলেজের সংখ্যা তিনটি। আর হাতীবান্ধা থানায় মোট কলেজ সংখ্যা দশটি। তন্মধ্যে এমপিও ভুক্ত ও নন এমপিও ভুক্ত কলেজেরে সংখ্যা প্রায় সমান। এখন ঘরে ঘরে উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়ে রয়েছে।
চলবে-

বাংলাদেশ সময়: ২০:৩৪:২৬ ● ৮৭৮ বার পঠিত