বঙ্গ-নিউজ: তখন দইখাওয়া ও তার আশেপাশে প্রচুর নাটক হতো। নারী-পুরুষ সবাই রাত জেগে সে সব নাটক উপভোগ করতেন। সেই নাটক কখনো কখনো দুই এক দিন ব্যাপিও হতো । দর্শক হতো প্রচুর। নাটক-যাত্রা চলতে চলতে ভোর হয়ে যেতো। আর ভোর হবে না এমন মনে হলে নাচ-গান ইত্যাদি সংযুক্ত করে প্রলম্বিত করা হতো অনুষ্ঠানকে। নাটক শেষ করে মধ্য রাতে দর্শকদেরকে বিদায় দিলে তাঁরাও অভিযোগ করতেন যে, এতো রাতে মেয়েছেলে সহ সবাই বাড়ি যেতে পারবেন না । তাই নাটক বৃদ্ধি করার জন্য চিন্তা করতে হতো। তখনকার সময়ে নাটক চলা কালে মাঝে মাঝে বিরতি দিতে হতো । দৃ্শ্যপট পরিবর্তন, প্রস্তুতি বা কৌতুক পরিবেশনের জন্য। তেমনি এক নাটকের বিরতিতে আমি কমার্শিয়াল সার্ভিস নামক এক ছোট নাটিকা তৈরী করে দইখাওয়া বাজারের সব ব্যবসায়ীদের সম্পর্কে রসঘন উপস্থাপনায় কৌতুক পরিবেশন করেছিলাম। উক্ত নাটকে আমি, আকরাম, নার্গিস, বিউটি ও পাপড়ী অভিনয় করে ছিলাম। নাটিকাটির একটি দৃশ্যের সামান্য বর্ণনা দিতে চাই।
মঞ্চে আমরা উপস্থাপনায় রত। বেতারে প্রচারিত কমার্শিয়াল সার্ভিসের অনুকরণে হলেও মঞ্চে আমাদেরকে অভিনয় করতে দেখা যাচ্ছিল। অনেকটা টিভি অনুষ্ঠানের মতো। যদিও সে সময় টিভি সম্পর্কে গ্রামাঞ্চলের মানুষদের কোন ধারনা ছিল না। এমন সময় দৌড়ে পাপড়ীর প্রবেশ।
পাপড়ী- আপা আপা, আমাদের খোকন সোনা পেটের ব্যাথায় কেমন যেন করছে।
নাগিস- ওহ্! সেই কথা ! কেন , আলমারীতে তো গ্রাইফ ওয়াটার রয়েছে।
আমি- হ্যাঁ, গ্রাইফ ওয়াটার!! শিশুদের পেটের পীড়ায় এক অব্যর্থ টনিক। ঘরে সবসময় একটি গ্রাইফ ওয়াটার রাখুন।
আকরাম- হ্যাঁ, গ্রাইফ ওয়াটার!! আর প্রাপ্তি স্থান “ বুলবুল ফার্মেসী, দইখাওয়া বাজার। প্রোপ্রাইটর মোঃ আব্বাছ আলী মিয়া। আজই একটি ফাইল সংরক্ষণ করুন।
আর একটি বিজ্ঞাপণ ছিল টেইলর মাস্টারকে নিয়ে। দইখাওয়াতে তখন দুইজন টেইলর মাস্টার ছিল। একজন মোঃ আব্দুস সোবহান মিয়া ও অপরজন মোঃ খোরশেদ আলম। তাদের পোশাক তৈরী নিয়ে লিখেছিলাম, বিখ্যাত টেইলর মাস্টার মোঃ আব্দুস সোবহান মিয়া । সেখানে পাবেন মনের মতো পোশাক ,বেলবটম পোশাক। বেলবটম মানে আগা মোটা গোড়া চিকন , অর্থাৎ কল্কির ন্যায় পেন্ট। আজই অর্ডার দিন। -এই ধরণের স্থানীয় প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের নামে ছিল বিজ্ঞাপণ।
সুধীর ছিল বেতারের একজন পরিচালক হিসাবে খুব সতর্ক অবস্থানে। বানিজ্যিক অনুষ্ঠান চলতে চলতে হঠাৎ প্রচারে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়ে যায়। সেটা মঞ্চ পরিচালকে নির্দেশনা দেওয়া ছিল । মঞ্চপরিচালক সাউন্ড সিস্টেম বন্ধ করে দেয়। লোকজন হৈ হুল্লোর শুরু করে, অর্থাৎ কি হলো কি হলো ভাব। পরে সুধীর সেটা মেরামত করে। বহু তার জোড়াতালি দিতে থাকে মঞ্চে। শেষে সে ”ও কে”, বলে অনুষ্ঠান শুরু করতে নির্দেশ দেয়। তখন আমি কত মিনিট কত সেকেন্ড অনুষ্ঠান প্রচারে বিঘ্ন হয়েছিল তা হিসাব করে দর্শকদের কে বলেছিলাম, “ যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য ৪৩ ওয়েভ ও ২৬ কি হা হতে ৫৩ কি হা , এবং ৫৪ কি হা হতে ৮৪ কিলোহার্সে মোট ৩মিঃ ৪৭ সেঃ আপনারা অনুষ্ঠান শোনতে পাননি বলে আমরা দুঃখিত। তখন বেতারে এইভাবে অজনপ্রিয় একটি ঘোষণা প্রায় নিয়মিতই শ্রোতাদেরকে শোনতে হতো। আমিও শুনিয়ে ছিলাম নাটকে। তখনও প্রত্যন্ত অঞ্চলে টেলিভিশন সম্প্রচার শুরু হয়নি। রেডিওতে সব কিছু শোনতে হতো। কমার্শিয়াল সার্ভিস চলতো। তার মধ্যে প্রচারিত হতো ছায়াছবির গান ও অন্যান্য জনপ্রিয় গান। আমরাও বলেছি, আপনাদের অনুরোধে এখন প্রচারিত হচ্ছে শরীফা রানীর কন্ঠে একটি ভাওয়াইয়া গান। আর সাথে সাথে মাইকে গান বেজে উঠলো। ফলে এই অনুষ্ঠানটি জনপ্রিয় হয়ে ছিল। আমাদের অনুষ্ঠানটির মাঝে আরো অনেক গান প্রচারিত হয়ে ছিল। জনপ্রিয় গান প্রচার করাতে দর্শক খুব আনন্দিত হয়েছিল। বেতারে প্রায় সময় শোনা যেতো ”যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে প্রচারে বিঘ্ন ঘটায় অথবা নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে এখন শোনবেন শাহনাজ রহমতুল্লাহর কন্ঠে গান “ এই ধরনের ঘোষণা। আর আমরাও মেনে নিতাম। আমাদের অনুষ্ঠানও অনুরূপ সব মিল রেখে করেছিলাম বলে দর্শকগণ খুব আনন্দ পেয়ে ছিল। মোটামোটি দর্শক প্রিয়তা পেয়েছিল অনুষ্ঠানটি। নাটকটিতে আমি সহ উল্লেখিত কয়েক জনের অভিনয় ছিল। নাটক ও নাটিকাটিতে অতিরিক্ত অভিনয় করতে হয়ে ছিল। প্রত্যেকটি মিষ্টির দোকান ও অন্যান্য ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বিজ্ঞাপন ছিল নাটিকাটিতে। স্ক্রিপ্ট আমিই তৈরী করে ছিলাম। বাজারে পাশাপাশি ছিল জেঠর চা দোকান, ছিল ভোলা মিয়ার চায়ের দোকান এবং ছিল নিপুচার চায়ের দোকান। তবে নিপুচার মিষ্টির দোকানটি ”বালুসাই” ভান্ডার নামে বেশী পরিচিতি পায়। কারণ নাটকের বাণিজ্যিক অনুষ্ঠানে এই নাম ব্যবহার করেছিলাম। ”বালুসাই” হলো ময়দা-চিনি সহযোগে তৈরী এক ধরনের মিষ্টি। দেখতে অনেকটা রোলস্ এর মতো। তাদের সবার সম্পর্কে প্রশংসাপূর্ণ উপস্থাপনা ছিল বাণিজ্যিক অনুষ্ঠানটিতে।
পাপড়ীকে নিয়ে স্কুলের স্পোর্টস চলাকালে আর একটি কাজ করেছিলাম। উজ্বল গৌড়বর্ণা এক ছাত্রী পাপড়ী ছিল খুব স্মার্ট। সে সাইকেল চালাতে পারতো খুব চমৎকার । সে সময়ে মেয়েদেরকে সাইকেল চালাতে কখনো দেখা যেতো না। আমি তাকে সামান্য মেকআপ দিলাম। একটি ইংলিশ প্যান্ট পড়িয়ে মাথায় একটি ইংলিশ ক্যাপ পড়িয়ে দিয়ে একটি বিশেষ ধরনের বাইসাইকেল দিলাম। মেকআপটি অপূর্ব হয়েছিল। বিদেশী বলেই ভ্রম হতে ছিল। সাথে আমি অন্য একটি সাইকেল নিয়ে মাঠে হঠাৎ এসে প্রবেশ করলম। প্রধান শিক্ষক, সভাপতি, সহকারী শিক্ষক ম্যানেজিং কমিটির সকল সদস্য সহ অন্যান্য গণ্যমান্য সকলের সাথে এই বলে পরিচয় করিয়ে দিলাম যে, তিনি এসেছেন হাতীবান্ধা সদর থেকে। স্পোর্টস দেখবেন বলে। হাতীবান্ধায় তখন ইউনিসেফ, আরডিআরএস সহ অনেক বিদেশী প্রতিষ্ঠান যুদ্ধোত্তর দেশে সাহায্য সহযোগিতার জন্য বিশাল বিশাল অফিস করেছে। আমি একজন দোভাষী হিসাবে ইংরেজিতে তাকে সবার পরিচয় জানাচ্ছিলাম, আর সে ঠিক সেভাবেই হাত মিলায়ে সবার সাথে দুএকটি শিখানো ইংরেজিতে কথা বলেছে। সে অনুষ্ঠান দেখতে পেরে এবং সবার সাথে পরিচিত হতে পেরে অনেক খুশি বলে জানায়। কেহই ব্যপারটি তখনও বুঝতে পারেনি। পরে খেলা শেষে প্রকৃত ঘটনা জানতে পেরে আমাদের দুজনকে ”যেমন খুশী তেমন সাজো” এর আওতায় দুটি পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল।
চলবে-