বঙ্গনিউজঃ পদ্মা সেতুতে টোল নির্ধারণের পর এবার বাস ভাড়া নির্ধারণ করেছে সরকার। ঢাকার সায়েদাবাদ টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যাওয়া ১৩টি রুটে আসনপ্রতি গড়ে ২০ টাকা ভাড়া বেড়েছে। এটি পদ্মা সেতুর টোলের সঙ্গে সমন্বয়কৃত হার। পদ্মা সেতুতে চলাচলরত বাসের এই টোল হার নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। তবে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের টোল চালু হলে ভাড়া আরও বাড়বে।
এদিকে শহরের মধ্য দিয়ে চললে যানজট বাড়বে, এই যুক্তিতে গাবতলী টার্মিনাল থেকে চলা বাস পদ্মা সেতু হয়ে যাতায়াতের রুট পারমিট পাচ্ছে না। গাবতলী থেকে চলার অনুমতি দিলে শহরের ভেতরে টেকনিক্যাল, আসাদগেট, ফার্মগেট, শাহবাগ, হাইকোর্ট, পল্টন হয়ে পোস্তগোলা বা বাবুবাজার সেতু দিয়ে বাস চললে যানজট বাড়বে।
কেবল গাবতলী নয়, উত্তরা বা মহাখালী এলাকা দিয়ে কোনো গাড়ি শহরের বাইরে দিয়ে পদ্মা সেতু পাড়ি দিতে চাইলে নতুন করে রুট পারমিট নিতে হবে। এ এলাকা দিয়ে চলা দক্ষিণবঙ্গের ১৯ জেলার বাস সার্ভিস থেকে কোনো আবেদন পায়নি বিআরটিএ। পরিবহনমালিকদের আবেদন পেলে রুট ও গন্তব্যভেদে দূরত্ব অনুযায়ী ভাড়া নির্ধারণ করা হবে।
রাজধানী ঘিরে বৃত্তাকার পথ (ইনার সার্কুলার রুট) নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত না হওয়ায় শহরের যানজট ঠেলে পদ্মা সেতুতে যেতে হবে। গাবতলী টার্মিনাল থেকে চলা দক্ষিণবঙ্গের বাস পাটুরিয়া ঘাটের পরিবর্তে পদ্মা সেতু হয়ে যেতে চাইলে একই অবস্থায় পড়তে হবে। বিকল্প হিসেবে মোহাম্মদপুরের বুদ্ধিজীবী সেতুর কেরানীগঞ্জের ভাওয়াল থেকে কলাতিয়া, হযরতপুর-রোহিতপুর সড়ককে ১৮ থেকে ২৪ ফুটে উন্নীত করা হয়েছে। এ পথে গাবতলীর গাড়ি এক্সপ্রেসওয়েতে যেতে পারবে বলে দাবি করা হচ্ছে। যদিও সরেজমিনে দেখা যায়, ভারী যান ও বাস চলাচলের উপযোগী নয় সড়কটি।
পদ্মা সেতু হয়ে চলাচলকারী বাসের ভাড়া পুনর্নির্ধারণ করতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি চিঠি দিয়েছে। সংগঠনের মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, এক্সপ্রেসওয়ে এবং পদ্মা সেতু হয়ে চলাচলকারী সব বাসের ভাড়ার সঙ্গে সেতু ও এক্সপ্রেসওয়ের টোল সংযুক্ত করে পুনর্নির্ধারণ করা প্রয়োজন। এ নিয়ে বিআরটিএর কর্মকর্তারা বলছেন, এক্সপ্রেসওয়ের টোলের হার চূড়ান্ত করার তথ্য এখনো জানানো হয়নি। গত বছরের নির্ধারিত হার (ভিত্তি কিলোমিটারে ১০ টাকা) বহাল থাকলে তা-ও অবগত করতে হবে। তাই এক্সপ্রেসওয়ের টোল ছাড়া কেবল পদ্মা সেতুর টোল ও ফেরির আগের চার্জ সমন্বয় করে নতুন হার নির্ধারণ করা হয়েছে। আর গাবতলী বা অন্য স্থান থেকে ছেড়ে যাওয়া গাড়ি পদ্মা সেতু পাড়ি দিতে চাইলে কোন রুট ব্যবহার করবে তা জানালে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবে বিআরটিএ। এজন্য বিআরটিএর পক্ষ থেকে পরিবহন নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আগ্রহের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে।
পরিবহন নেতারা জানান, পদ্মা সেতু পাড়ি দিতে চাইলে গাবতলী টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যাওয়া সব গাড়ি সায়েদাবাদে সংকুলান হবে না। বিপুলসংখ্যক গাড়ি কোন পথ দিয়ে নতুন করে চলাচল করবে তা নিয়ে দ্বিধায় আছেন পরিবহন মালিকরা। কারণ গাবতলী থেকে বছিলা হয়ে যেতে চাইলে ওই সড়কটি ভারী যান চলাচলের উপযোগী নয়। ফলে উপায় কী হবে এ নিয়ে ডিটিসিএ, ডিএমপি ও বিআরটিএসহ সংশ্লিষ্টদের বসে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে। তবে কিছু বাসমালিক আগামী সপ্তাহ থেকে রুট পারমিটের জন্য আবেদন করতে পারেন।
এ বিষয়ে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার আমাদের সময়কে বলেন, সায়েদাবাদ থেকে যেসব গাড়ি পদ্মা পাড়ি দেবে ফেরির পরিবর্তে সেসব রুটের ভাড়ার হার পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্য কোনো পরিবহন রুট পারমিট চাইলে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ আসবে। তবে এখনো লিখিতভাবে কোনো আগ্রহী মেলেনি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সায়েদাবাদ থেকে বরিশালের দূরত্ব ১৫৬ কিলোমিটার। আর গাবতলী থেকে পাটুরিয়া হয়ে বরিশালের দূরত্ব ২৪২ কিলোমিটার। সায়েদাবাদ থেকে খুলনা ২৪৭ কিলোমিটার। গাবতলী থেকে আড়পাড়া হয়ে খুলনা ২৭২ কিলোমিটার। আর ঝিনাইদহ ভায়া ধরলে গাবতলী থেকে খুলনার দূরত্ব ২৯২ কিলোমিটার। অর্থাৎ গাবতলী থেকে বরিশাল অঞ্চলে পাটুরিয়ার পরিবর্তে পদ্মা সেতু দিয়ে যেতে চাইলে গড়ে দূরত্ব কমবে অন্তত ১০০ কিলোমিটার। এজন্য রুট পারমিট লাগবে। আপাতত সায়েদাবাদ থেকে বরিশালের ভাড়া ধরা হয়েছে ৪১২ টাকা। এ রুটে ভায়া হচ্ছে মাওয়া, ভাঙা, মাদারীপুর। সায়েদাবাদ থেকে গোপালগঞ্জ ভায়া মাওয়া, রাজৈর ১৮৮ কিলোমিটার দূরত্বে ভাড়া ৫০৪ টাকা, সায়েদাবাদ থেকে খুলনা ভায়া গোপালগঞ্জ ভাড়া ৬৪৯ টাকা, সায়েদাবাদ থেকে শরীয়তপুর ৭৩ কিলোমিটারের জন্য ২১৮ টাকা, পিরোজপুরের রুটে ভায়া মাওয়া-বরিশাল ২০৬ কিলোমিটারের ভাড়া ৫৩৪ টাকা। এছাড়া পিরোজপুরগামী বাসে গোপালগঞ্জ ও বাগেরহাট হয়ে গেলে ২৩৯ কিলোমিটারের জন্য ৬২৮ টাকা, মাওয়া, ভাঙা, বরিশাল হয়ে পটুয়াখালী যেতে ১৯২ কিলোমিটারের জন্য ভাড়া ৫০১ টাকা, সায়েদাবাদ থেকে মাদারীপুর যেতে ১১১ কিলোমিটারের জন্য ৩২৭ টাকা, ২৫০ কিলোমিটার দূরত্বে সাতক্ষীরা যেতে চাইলে গোপালগঞ্জ ও খুলনা ভায়া হিসাবে ধরে ৬৩৩ টাকা ভাড়া গুনতে হবে। একইভাবে ফরিদপুরের জন্য ১০২ কিলোমিটারে ভাড়া হবে ২৮৮ টাকা, সায়েদাবাদ থেকে ভোলার চরফ্যাশন ২৫৭ কিলোমিটার, ভাড়া ৬৫৩ টাকা। শরিয়তপুরের জন্য ৭৩ কিলোমিটার দূরত্বে লাগবে ২১৯ টাকা এবং সায়েদাবাদ থেকে কুয়াকাটা ভায়া মাদারীপুর, বরিশাল ও পটুয়াখালী ২৭৬ কিলোমিটারের জন্য ৬৯৪ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করেছে বিআরটিএ।
দূরপাল্লার ৫১ আসনের বাসে প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া এক টাকা ৮০ পয়সা। তবে বাসের ভাড়া নির্ধারণ হয় ৪০ আসন ধরে। ফলে কিলোমিটার প্রতি প্রকৃত ভাড়া দুই টাকা সাড়ে ২৯ পয়সা। এর সঙ্গে যোগ হবে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে ও পদ্মা সেতুর টোল। এক্সপ্রেসওয়ের টোল কার্যকরের প্রজ্ঞাপন না হওয়ায়, বিআরটিএ তা বাদ দিয়ে ভাড়া নির্ধারণ করেছে। সংস্থাটির কর্মকর্তারা জানিয়েছে, প্রজ্ঞাপন জারি হলে যাত্রী প্রতি ভাড়া আরও ১২ টাকা ৩৮ পয়সা বাড়বে। এক্সপ্রেসওয়ের টোল ৪০ দিয়ে ভাগ করে যাত্রী প্রতি ভাড়া নির্ধারিত হবে। পদ্মা সেতু ও এক্সপ্রেসওয়ের টোলের জন্য ভাড়া বাড়বে মাত্র ২২ টাকা। এ হিসেবে ঢাকা-বরিশালের ভাড়া দাঁড়াবে ৪১২ টাকা ৩২ পয়সা এবং ১২ টাকা ৩৭ পয়সার যোগফল অর্থাৎ ৪২৪ টাকা ৬৯ পয়সা। আদায়যোগ্য ভাড়া হবে ৪২৫ টাকা। বাকি ১২ রুটে ভাড়া হবে ঢাকা-গোপালগঞ্জ ৫১৭, ঢাকা-খুলনা ৬৬২, ঢাকা-শরিয়তপুর ২৩১, ঢাকা-পিরোজপুর ৬৪১, ঢাকা-পটুয়াখালী ৫১৩, ঢাকা-মাদারীপুর ৩৪০, ঢাকা-সাতক্ষীরা ৬৪৫, ঢাকা-ফরিদপুর ৩০১, ঢাকা-চরফ্যাশন ৬৬৬, ঢাকা-শরিয়তপুর ভায়া বাবুবাজার ২৩২ এবং ঢাকা-কুয়াকাটা ৭০৯ টাকা।
পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণবঙ্গমুখী যানবাহনের রাজধানী এড়িয়ে পদ্মা সেতুতে যাওয়ার পথ নেই। রাজধানীর ভেতর দিয়ে দূরপাল্লার গাড়ি চলাচলের বৈধতা নেই।
সওজের তথ্য মতে, আবদুল্লাহপুর-ধউর-বিরুলিয়া-গাবতলী-সোয়ারিঘাট-বাবুবাজার-কদমতলী-তেঘরিয়া-পোস্তগোলা-ফতুল্লা-চাষাঢ়া-হাজিগঞ্জ-ডেমরা হয়ে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত তথা ঢাকার চারদিকে ইনার সার্কুলার রুট নির্মাণের পরিকল্পনা করে সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)। এটি নির্মিত হলে দেশের যে কোনো অঞ্চল থেকে আসা গাড়ি শহরে প্রবেশ না করে ঢাকাকে বাইপাস করে যেতে পারত। একই সুবিধা পেত পদ্মা সেতুমুখী গাড়ি। কিন্তু অর্থায়ন নিশ্চিত না হওয়ায় প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) কাছে অর্থায়নের জন্য প্রস্তাব করেছিল সওজ। চীনের ব্যাংকটি গত ছয় মাসে যোগাযোগই করেনি। অথচ সমীক্ষার কাজ শেষে হয়েছে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে।
প্রকল্পের পরিচালক সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খান বলেছেন, উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) প্রণয়ন চলছে। অর্থায়ন নিশ্চিত হয়নি। তাই স্পষ্ট বলা যাচ্ছে না, কবে প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে কিংবা কাজ শুরু হবে।
সওজ কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকল্পটি সরকারের অনুমোদন পাওয়া থেকে শুরু করে দরপত্রের দীর্ঘ প্রক্রিয়া পেরিয়ে নির্মাণ কাজ শুরু করতে অন্তত বছর দুয়েক লাগবে। সড়ক নির্মাণে কমপক্ষে আরও বছর দুই লাগবে। গাবতলী-কদমতলী অংশের কাজ পরিকল্পনায় ঘুরপাক খাওয়ায় ২০২০ সালে অক্টোবরে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সওজ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রায় সাড়ে ৬২ হাজার যাত্রী প্রতিদিন ঢাকার উত্তর-পূর্ব অঞ্চল থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সরাসরি নদী পার হয়ে যায়। প্রতিদিন ২ হাজার ৯০৯টি যানবাহন পদ্মা পাড়ি দেয়, এর মধ্যে ১ হাজার ২৯৫টি ট্রাক, ৭০০টি হালকা যান এবং ৯১৪টি বাস। পদ্মা সেতু চালু হলে গতি বৃদ্ধির কারণে গাড়ির দৈনিক পরিচালন ব্যয় কমে আসবে। এর ফলে পরিবহনের বছরে সাশ্রয় হবে ৪৩৮ কোটি টাকা। আর ফেরির অপেক্ষার সময় যোগ করলে সাশ্রয় হওয়া সময়ের মূল্য দাঁড়ায় ১ হাজার ১১৮ কোটি টাকা। এখন কোন রুট দিয়ে গাবতলী অঞ্চলের গাড়ি চলবে তা নির্ধারণ করাই বড় চ্যালেঞ্জ।