বঙ্গনিউজঃ দীর্ঘ ৬১ ঘণ্টা পর বিএম কন্টেইনার ডিপোর সীতাকুণ্ডের আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। আগুন লাগার ৩ দিনের মাথায় গতকাল সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার কথা গণমাধ্যমকে জানানো হয়। এখন চলছে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যৌথ উদ্ধার কাজ। আর এই সময়ে উদ্ধার করা হয়েছে আরও দুইজনের ভস্মীভূত লাশ, বেশ কয়েকটি হাড়ের খণ্ড। ওদিকে দুর্ঘটনায় আহতরা কাতরাচ্ছেন হাসপাতালে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি রোগীদের অনেকের অবস্থা গুরুতর। তাদের কেউ কেউ আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনার ৩ দিনেও কোনো মামলা হয়নি। নতুন করে ২ লাশ উদ্ধার হওয়ায় সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩ জনে। আহতদের চিকিৎসার সব খরচ বহন করার ঘোষণা দিয়েছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।
গতকাল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহায়তা ডেস্কে এক সংবাদ সম্মেলনে জেলা প্রশাসক মোমিনুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন, কারও চিকিৎসায় যাতে কোনো অবহেলা না হয়। আহতদের চিকিৎসার সব ব্যয় বহন করবে সরকার।
মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টায় সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের ১৮ ব্রিগেডের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফুল ইসলাম হিমেল বলেন, এখন যে আগুনটা আছে তা প্রায় পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে। এখান থেকে আর কোনোভাবে আগুন ছড়ানোর সুযোগ নেই। কিছু কন্টেইনার জ্বলছে। তবে আমরা নিশ্চিত হয়েছি এখানে কোনো বিস্ফোরক নেই। কাজেই এখান থেকে আর আগুন ছড়ানোর সুযোগ নেই। তিনি বলেন, এই ডিপো এলাকাটি প্রায় ২৬ একর জায়গার উপর অবস্থিত। ঘটনার সময়ই সেখানে প্রায় ৪ হাজার কন্টেইনার ছিল। কন্টেইনারগুলো একটির পর আরেকটি লাগানো ছিল। কন্টেইনারগুলো নিচে নামিয়ে কাজ করতে সময় লেগেছে বেশি। আর কোনো কন্টেইনারে বিস্ফোরক ছিল সেটা নিশ্চিত না হওয়ার কারণেও আমাদের বেকায়দায় পড়তে হয়েছে।
এদিকে ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, আগুন নিয়ন্ত্রণের পর মূল অগ্নিকাণ্ডের স্থান থেকে দুটি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া উদ্ধার করা হয়েছে বেশকিছু হাড়। উদ্ধারকৃত লাশের মধ্যে একটি ফায়ার সার্ভিস কর্মীর বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে লাশ অনেকটা পুড়ে কঙ্কাল হয়ে যাওয়ায় বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক আনিসুর রহমান বলেন, এই পর্যন্ত ৪৩ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আজ সকালেই দুইটা লাশ ও কিছু হাড়গোড় পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিসের ৯ কর্মী নিহত হয়েছেন। ১২ জন সিএমএইচে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তিনজন এখনো নিখোঁজ আছেন। তাদের পরিবারের সদস্যরা এসে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনা দিয়েছেন। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কত হতে পারে বলে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি এখনো বলা যাচ্ছে না। কর্তৃপক্ষ এখনো বিষয়টি খোলাসা করে নি। তবে এতটুকু বলতে পারি ওই প্রতিষ্ঠানের স্থাবর সম্পত্তি বাবদ খরচ হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। আর এতগুলো মানুষ লাশ হলো, এখনো অনেকেই নিখোঁজ আছেন। পঙ্গু হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন এতগুলো মানুষ। সেগুলো আপনি টাকায় হিসাব করবেন কীভাবে?
এদিকে এই ঘটনায় এখনো কোনো মামলা হয়নি। এ ছাড়া কেউ অভিযোগও দায়ের করেননি। তবে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস আলাদাভাবে মোট ৩ টি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষও একটা আলাদা কমিটি গঠন করেছে। ঘটনায় নিহত ও আহতদের জন্য সরকারি ও বেসরকারিভবে অনুদান দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে ডিপো কর্তৃপক্ষ নিহত কর্মীদের পরিবারের জন্য ১০ লাখ ও আহতদের জন্য ৬ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। এ ছাড়া ফায়ার সার্ভিসের নিহত ও আহত কর্মীদের জন্যও অনুদান ঘোষণা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এই ঘটনায় কোনো মামলা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার এস এম রশিদুল হক বলেন, বিষয়টি তদন্তাধীন আছে। কয়েকটি সংস্থা তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তদন্ত কমিটিগুলোর সুপারিশের আলোকে দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে।
এদিকে সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার টার্মিনালের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে নিছক অগ্নি দুর্ঘটনা কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। মঙ্গলবার ঢাকায় ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরে নিহত ফায়ার ফাইটার মো. শাকিল তরফদারের জানাজায় অংশগ্রহণ শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, দুটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত দল দুর্ঘটনাস্থলে কাজ করছে। তদন্তের ফল প্রকাশ না পাওয়া পর্যন্ত কার গাফিলতি কিংবা নাশকতা বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ঘটনা কিনা তা বলতে পারছি না। কিছু একটা ঘটেছে, তা না হলে এত প্রাণ যায় না, এটাও আমি বিশ্বাস করি।
ঢাকায় আনা ২ ফায়ার ফাইটারের অবস্থা আশঙ্কাজনক, গুরুতর আহত ৮ জন: চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডির বিএম কন্টেইনার ডিপোতে আগুনের ঘটনায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি দুই ফায়ার ফাইটারের অবস্থা আশঙ্কাজনক। অন্য ৮ জনের অবস্থাও গুরুতর। আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসা নিচ্ছেন ফায়ার ফাইটার গাউসুল আজম এবং রবিন। তাদের মধ্যে গাউসুলের শরীর ৭০ শতাংশ এবং রবিনের শরীর ৬০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। এ ছাড়া তাদের মধ্যে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন বিএম কন্টেইনার ডিপোতে আগুনের ঘটনায় দগ্ধ ৫৮ বছর বয়সী খালেদুর রহমান। বর্তমানে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। খালেদুরের শরীরে কোমর থেকে নিচের অংশ ঝলসে গেছে। এ ছাড়া তার একটি চোখ আগুনের তাপে আক্রান্ত হয়েছে। দগ্ধ খালেদুরের বর্তমান শারীরিক অবস্থা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন দায়িত্বরত চিকিৎসকরা। হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিএম কন্টেইনার ডিপোতে আগুন-বিস্ফোরণের ঘটনায় দগ্ধ ব্যক্তিদের মধ্যে ১৯ জনকে ঢাকায় এনে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তাদের মধ্যে মইনুল হক, মো. রুবেল, মহিবুল্লাহ, ফারুক, নাজমুল, সজীব, বদরুজ্জামান রুবেল এবং খালেদুর রহমানের অবস্থা গুরুতর।
এছাড়া ফায়ার ফাইটার গাউসুল আজম, রবিন, মাকফারুল ইসলাম, ফরমানুল ইসলামের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের মধ্যে ফায়ার ফাইটার গাউসুল আজম এবং রবিন দু’জনের বয়সই ২২ বছর। সবচেয়ে কম দগ্ধ হয়েছেন মো. সুমন হালদার। তার শরীর ২ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। এছাড়া দগ্ধদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী (১৬) ফারুকের শরীর ১২ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। মাকফারুল ইসলাম, গাউসুল আজম এবং রবিনের অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাদেরকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়েছে। এর আগে গত রোববার দুপুরে রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয় খালেদুর রহমানকে। পরবর্তীতে তার করোনা পজেটিভ হওয়ায় খালেদুরকে ঢাকা মেডিকেলের করোনা ওয়ার্ডে এবং রাসেল ও এনামুলকে মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে।