বঙ্গ-নিউজ: দৈনিক জাগরন পত্রিকায় ২৯/০৮/২০১৯ তারিখে বিশিষ্ট সাংবাদিক আবেদ খান ধারাবাহিক একটি সচিত্র প্রতিবেদন লিখেন। তিনি লিখেন , আফতাব আহমেদ ছিলেন ইত্তেফাকের প্রধান আলোকচিত্র সাংবাদিক। বাড়ি রংপুর। পেশাগত কারনে পাকিস্তান আমল থেকেই খন্দকার মোশতাক আহমেদ এবং তাহের উদ্দিন ঠাকুরের অতি বিশ্বস্ত । স্বাধীনতার পর মোশতাক ঠাকুর চক্র তাকে কৌশলে ব্যবহার করতে শুরু করে এবং এক সময় আফতাব তাদের এতখানি বিশ্বস্ত হয়ে ওঠেন যে, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকান্ডের যাবতীয় আলোকচিত্র ধারনের জন্য একমাত্র তাকেই ঘাতকের পক্ষ থেকে বাছাই করা হয়। ঘাতকদের দেওয়া সেই দায়িত্ব তিনি বিশ্বস্ততার সঙ্গে পালন করেন। শফিকুল কবির একাত্তরে ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী কথিকার রচনাকারী ছিলেন। একাত্তরে স্বাধীনতা বিরোধীদের ভূমিকার তালিকায় তার নাম এবং তার কথিকাটির নাম লিপিবদ্ধ করা আছে। কাকতালীয় হলেও এই দু’জনই ২০১৩ সালে অস্বাভাবিক মৃত্যুর শিকার হয়েছেন। ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা এবং ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ও সময়ে।
’৯৮ সালের জুন মাসে ফটো জার্নালিস্ট এ্যাসোসিয়েশনের একযুগ পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া চুয়াত্তরের দুর্ভীক্ষের উপর তোলা বাসন্তীর ছবির জন্য আফতাব আহমেদ কে পুরস্কৃত করার ঘোষণা দেন। ২০০৬ সালে বিএনপি-জামাত জোট সরকার আফতাব আহমেদ কে একুশে পদক প্রদান করেন। এর মাধ্যমে আফতাব আহমেদের স্বাধীনতা বিরোধী চেতনা প্রকাশ পায়। এরপর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ছাত্র শিবির আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে জামায়েতের তৎকালীন আমির ,একাত্তরের আলবদর বাহিনীর নেতা মতিউর রহমান নিজামীর হাত পদক গ্রহণের মধ্য দিয়ে আফতাবের জামাতি কানেকশনের বিষয়টি সবার কাছে স্পষ্ট হয়। বুদ্দুরাম দাস আপত্তি জানিয়ে ছবি তুলতে নিষেধ করে ছিলেন। তবুও তারা শোনেন নি। বুদ্দুরাম দাস জানান, ”চেয়ারম্যান সাব, ছেঁড়া হউক আর ফাড়া হউক, একনা তো শাড়ি আছে , উয়ার উপরত ফির জাল খান ক্যা পড়ান; ইয়ার মানে কি? ( সূত্র- চিলমারীর এক যুগ- মোনাজাত উদ্দিন )।
আবেদ খান আরও লিখেন, চূযাত্তরের দুর্ভীক্ষ এবং ‘বাসন্তী ও দুর্গতী” উপ্যাখ্যান নিয়ে অনেক লেখক , সাংবাদিক ও গবেষক কাজ করেছেন। তাদের একজন সাংবাদিক জাকির হোসেন। ২০০০ সালে তিনি কুড়িগ্রাম যান আনছার আলী বেপারী এবং বাসন্তীর সঙ্গে দেখা করতে। এই আনছার আলী বেপারী বাসন্তীর ছবি তুলতে সহযোগীতা করে ছিলেন। চুয়াত্তরে আনছার আলী ছিলেন কুড়িগ্রামের রমনা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সারা দেশের সকল ইউনিয়নে বিনা নির্বাচনে যাদের চেয়ারম্যান হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, আনছার আলী বেপারী তাদেরই একজন। পেশায় তিনি পাটের বেপারী। স্থানীয় বাজার থেকে পাট কিনে বিক্রি করতেন সিরাজগঞ্জ সহ দেশের বড় বড় পাটের বাজারে। আনছার আলীর বাড়ির বৈঠক খানায় তার সঙ্গে দীর্ঘ সময় কথা হয় এই গবেষণা কর্মের অন্যতম সহযোগী সাংবাদিক জাকির হোসেনের ।
আলাপকালে আনছার আলী বলেন,তিনি বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ ভক্ত ও কর্মী। আর এ কারনেই তাকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে চেয়ারম্যা হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। চুয়াত্তরের দুর্ভীক্ষের সময় বঙ্গবন্ধু সারা দেশের চেয়ারম্যানদের লঙ্গর খানা খোলার নির্দেশ দিলে আনছার আলীও তার বাড়ির পাশে লঙ্গর খানা খুলে ছিলেন। ওই সময়ে ঢাকা থেকে হঠাৎ একদিন দুজন সাংবাদিক তার কাছে আসে। এই দুইজন সাংবাদিকের একজনের নাম আফতাব আহমেদ, আর এক জনের নাম তার মনে নেই। সাংবাদিক দুই জন আনছার আলীকে জানান, বঙ্গবন্ধু তাদেরকে পাঠিয়েছেন দরিদ্র মানুষের ছবি তোলার জন্য। এই ছবি দেশ-বিদেশের পত্রিকায় ছাপা হলে বিদেশ থেকে অনেক রিলিফ আসবে। দেশে কোন অভাব থাকবে না। আর এই ছবি তোলার কাজে তিনি ( আনছার আলী ) যদি সহযোগীতা করেন তবে তার নামও দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। এ কথা বলেই আনছার আলী কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। কেননা এই কাজের জন্য তিনি ভীষণ ভাবে অনুতপ্ত। কারন তার নাম ইতিহাসের পাতায় সোনার হরফে লেখা হয়নি। ওই কাজে সহযোগীতা করার জন্য এলাকার সকল মানুষের কাছে তিনি ঘৃণার পাত্র। বাসন্তীর কাহিনী তাকে ইতিহাসের পাতায় নায়ক নয়, খলনায়কে পরিণত করেছে।
বয়সের ভারে ন্যুব্জ আনছার আলী চোখ মুছে বিষন্ন মনে , ক্ষীন কন্ঠে বলেন, ছবি তোলার জন্য তিনি ওই দুই সাংবাদিককে জেলে পাড়ায় নিয়ে যান। সেখানে দুই সাংবাদিক তাদের পরিকল্পনা মাফিক ছবি তোলেন। পরের কাহিনী সবারই জানা।
তবে পত্রিকায় বাসন্তীর নামে যে জাল পরা যে ছবি ছাপা হয়েছে, সেটা বাসন্তীর ছিল না। ওই ছবিটি ছিল বাসন্তীর কাকাতো বোন দুর্গতির। দুর্ভীক্ষের সময় দুগর্গতিরা সপরিবারে ভারতে চলে যায়। সেখানে যাওয়ার পর ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে দুর্গতি মারা যায়। তবে বাক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বাসন্তী দুই সাংবাদিকের চক্রান্তের সাক্ষী হিসাবে আজও বেঁচে আছে। বেঁচে আমিও আছি।
উল্লেখ্য , জাকির হোসেনের সঙ্গে আনছার আলীর আলাপচারিতার কয়েক মাস পর ২০০১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর আনছার আলী মারা যান। যুদ্ধ বিধ্বস্থ দেশে ’৭৪ এ পাক-মার্কিন ষড়যন্ত্রে দেশে দুর্ভীক্ষ দেখা দেয়। আর এই দুর্ভীক্ষের প্রেক্ষাপটে এক নির্মম ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে মঞ্চস্থ হয় বাসন্তী নাটক। চলবে-