বঙ্গনিউজঃ গ্রামগঞ্জে চড়া সুদের ব্যবসা করে মানুষকে নিঃস্ব করে দিচ্ছে এক শ্রেণির কারবারি। অথচ তাদের সুদ ব্যবসার জন্য কোনো নিবন্ধন নেই। ‘সমবায় সমিতি’র নামে, কেউবা ব্যক্তিগতভাবে চড়া সুদে ব্যবসা করে যাচ্ছে। এতে ঋণগ্রস্ত মানুষ পথে বসে যাচ্ছেন।
দেশের অনিবন্ধিত ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ও সমবায় সমিতি বন্ধে গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। একইসঙ্গে অননুমোদিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে তদন্ত করতে একটি বিশেষ কমিটি গঠনে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশনা দিয়েছিলেন আদালত। তদন্তকালীন কোনো অননুমোদিত বা লাইসেন্সবিহীন প্রতিষ্ঠান পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক সেগুলো বন্ধ করে আইনগত ব্যবস্থা নিতেও নির্দেশ দেওয়া হয় এই আদেশে।
এছাড়া চড়া সুদে ঋণদানকারী স্থানীয় মহাজনদের তালিকা দিতে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত। তবে সুদ ব্যবসা বন্ধে এমন কড়াকড়ি থাকার পরও হাওরের জেলা সুনামগঞ্জে চলছে সুদখোরদের রমরমা বাণিজ্য। একই সাথে বেড়েছে তাদের দৌরাত্ম্য। এ অবস্থায় সুদখোরদের ধরতে উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত অবৈধ সুদের ব্যবসার সাথে জড়িতদের তালিকা তৈরি করে তাদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
সুনামগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি এবং সুনামগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতি সূত্রে জানা যায়, সুনামগঞ্জ জেলায় অবৈধ সুদের ব্যবসা সাথে সক্রিয় রয়েছেন কয়েক হাজার মহাজন। কেউ নামে-বেনামে সংগঠন-সমিতি বা ব্যক্তি পর্যায়ে সুদে টাকা লেনদেনের ব্যবসা করে থাকেন। ক্ষুদ্র, মাঝারি সহ বৃহৎ আকারে এই ব্যবসা পরিচালনা হয়ে থাকে। দিন, সপ্তাহ, মাস ও বার্ষিক হারে সুদ গ্রহণ করেন দাদন ব্যবসায়ীরা। অনেকেই প্রমাণ হিসেবে ব্যক্তির কাছ থেকে জমির দলিল, চেকের পাতা, মূল্যবান জিনিসপত্র অথবা বন্ডসই আদায় করে থাকেন। যা এক সময়ে সুদ আদায়ে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
সুদে টাকা গ্রহণ করে চড়া সুদ পরিশোধ না করতে পেরে চক্রবৃদ্ধি সুদে নিঃস্ব হয়ে যান অনেকেই। এই দুই প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী সুনামগঞ্জ জেলা শহরসহ উপজেলা পর্যায়ে অনেক ব্যবসায়ী সুদের ব্যবসার খপ্পরে পরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সুনামগঞ্জ পৌর শহরে রয়েছে সুদ ব্যবসার একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। সমিতি বা ব্যক্তি বিশেষের নামে এবং প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় সুদের ব্যবসা করে শক্তিশালী সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিচ্ছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাসাবাড়ি। সুদি মহাজনদের খপ্পরে পড়ে শহরের অনেক গার্মেন্টস ব্যবসায়ীসহ ক্ষুদ্র মাঝারি উদ্যোক্তা সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। প্রভাবশালী সুদখোর চক্র সুদের জাল বিছিয়ে অনেকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মার্কেট, বাসাবাড়ি, জায়গা-সম্পত্তি সুকৌশলে নিজের কবজায় নেয়ারও দৃষ্টান্তও রয়েছে। এমন একাধিক ব্যক্তি রয়েছেন যারা এই সুদের ব্যবসার মাধ্যমে রাতারাতি শূন্য থেকে অট্টালিকার মালিক বনেছেন। হয়েছেন অঢেল সম্পদের মালিক।
অনুসন্ধানে আরও জানাযায়, সুদি মহাজনদের রয়েছে নিজস্ব এজেন্ট। যাদের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ব্যবসা পরিচালিত হয়ে থাকে। বিপদগ্রস্ত মানুষকে দারদেনা নামে মুনাফাভিত্তিক প্রতিশ্রুতি হচ্ছে এই ব্যবসার প্রথম ধাপ। টাকা গ্রহীতার কাছ থেকে নেয়া হয় ব্লাঙ্ক চেক বা খালি স্টাম্পে স্বাক্ষর। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাখা হয় জায়গা সম্পত্তির দলিল। চক্রবৃদ্ধি হারে সুদের টাকা পরিশোধ করতে না পারলে ব্লাঙ্ক চেক বা অন্যান্য কাগজপত্র অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হয় সুদ গ্রহীতার বিপক্ষে। কোনো এক পর্যায়ে ‘চেক জালিয়াতি’ মামলার আসামি হতে হয় ঋণগ্রহীতাকে। মহাজনরা তাদের নিজস্ব লোকদের দিয়ে ব্লাঙ্ক চেকের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকার পরিমাণ বসিয়ে মামলা করেন। এইভাবে নামে-বেনামে একাধিক মামলা চলমান থাকে। প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য ও প্রমাণের অভাবে মামলায় হেরে প্রভাবশালী দাদন ব্যবসায়ীদের কাছে সমর্পণ করতে হয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাসাবাড়ী বা জায়গা সম্পত্তি। প্রকাশ্যে দিবালোকে এমন সুদ ব্যবসার দৌরাত্ম্য বাড়তে থাকলেও দাপুটে মহাজনদের ভয়ে প্রতিবাদ করতে দেখা যায় না কাউকে।
এইভাবে চলতে থাকলেও সুদি ব্যবসা সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন সিনিয়র আইনজীবী হোসেন তওফিক চৌধুরী। তিনি বলেন, কোনো ধরনের কর না দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে সম্পূর্ণ অবৈধ। তাছাড়া কৌশলে ব্লাঙ্ক চেক আদায় বা সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেয়া কখনোই আইন সম্মত নয়। মানুষ নিরুপায় হয় সুদে টাকা আনে। ব্লাঙ্ক চেক নিয়ে পরবর্তীতে ইচ্ছে মতো টাকার পরিমাণ লিখে মামলা করা হয়। অনেক মামলাই এভাবে বছরের পর বছর চলতে থাকে। সরকারের উচিত সুদের ব্যবসার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। এই অবৈধ ব্যবসা বন্ধ করা।
সুনামগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোশনুর বলেন, সুনামগঞ্জ শহরে অনেকেই সুদের ব্যবসার সাথে জড়িত। তারা এই ব্যবসা করে রাতারাতি বড়লোক বনে যাচ্ছেন। সুদের টাকা আদায় ও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া নিয়ে অনেক অভিযোগ আসে। স্থানীয় সালিশে আমাকে অনেকেই রাখতে চান। আমি এর ঘোর বিরোধী। আমাদের কাছে অনেকের তালিকা রয়েছে। সরকার চাইলে সহযোগিতা করা হবে।
সুনামগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি খায়রুল হুদা চপল বলেন, কোনো ধরনের বৈধতা ছাড়া সুদের রমরমা ব্যবসা চলছে। আমাদের অনেক ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আমি প্রায় সময় সরকারের সংশ্লিষ্ট সভায় এই বিষয়ে কথা বলেছি। সরকারের নির্দেশনা আসলে তালিকা তৈরি করা হবে।
জেলা সমবায় অফিসার বশির আহমদ বলেন, সরকার অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান ছাড়া ক্ষুদ্রঋণ বা টাকা লেনদেনের ব্যবসা করার সুযোগ নেই। আমাদের কর্মকর্তাদের বলা আছে, যে প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি সুদের ব্যবসা করবে তাদের তালিকা করতে। কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি অবৈধভাবে ব্যবসা করলে তা বন্ধ করা হবে। সাথে সাথে আইনী পদক্ষেপ নেয়ার কথাও জানান তিনি। জেলা পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান বিপিএম বলেন, সুদ ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া বা হয়রানি হওয়ার কোনো অভিযোগ পেলে বিহিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। উচ্চ আদালতের নিদের্শনা প্রতিপালনের কথা জানিয়ে জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, মহামান্য হাইকোর্টের যে নির্দেশনা থাকবে তা কার্যকর করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।