রবিবার ● ১৫ মে ২০২২
সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব -১ : স্বপন চক্রবর্তী
Home Page » সাহিত্য » সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব -১ : স্বপন চক্রবর্তীবঙ্গ-নিউজ: ( গত নভেম্বর’২১ এর শেষ সপ্তাহে হাতীবান্ধা উপজেলার দইখাওয়া সীমান্তে বেড়াতে গিয়েছিলাম। তার উপর কিছু লিখার জন্য অনুরোধও ছিল। তাই বসে বসে সময় ক্ষেপন করেছি মাত্র। জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা হেতু সন্নিবেশিত ভুল তথ্য শুধরে দিলে উপকৃত হবো )।
আমার এক নাতি, তার একান্ত অনুরোধ যে, তার বিবাহে আমি যেন সশরীরে উপস্থিত থাকি। পরপর দুবার সে এই বার্তা দিতে আমার ঢাকার বাসায় এসেছে। যদিও তার জন্মের পূর্বেই আমি তার জন্মস্থল হাতীবান্ধার দইখাওয়া ত্যাগ করি। দইখাওয়ায় আমি আগেও ছিলাম। এটা আমার প্রথম দফায় গমন নয়। তবে ক্ষণিক যাত্রায় কখনো গেলেও সময় নিয়ে এটা ছিল পাঁচ দশক পরের ঘটনা। ঘটনা চক্রে নাতিটি ঢাকায় পড়াশোনা করতে আসে। গড়ে উঠে আমার সাথে এক অসমবয়েসী বন্ধুত্ব। তাকে নিয়ে সর্বত্র চলাফেরা করাই এক সময় আমার অভ্যাসে পরিণত হয়। এই ভাবে সে আমার হাতের লাঠি হয়ে উঠে। তাকে নিয়ে গিয়েছি অগ্রণী ব্যাংকে, অগ্রণী ব্যাংকের আইটি এন্ড এমআইএস ডিভিশনের গাজীপুরস্থ ফিস পার্ক পিকনিক স্পটে। সাথী হয়েছে ব্যাংকের স্পোর্টসের অনুষ্ঠানে। নিয়ে গিয়েছি টাঙ্গাইল আমার আত্মীয়ের বাড়ি এক সামাজিক অনুষ্ঠানে। সে আমার সাথে গেছে আমার শ্বশুর বাড়ি । আমি যখন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সন্যাসীর সাজ নিয়ে আবৃত্তি করেছি রবী ঠাকুরের অমর কবিতা “ দুই বিঘা জমি”,তখন পাছে সংলাপ ভুল হয়ে যায়, তাই নাতি সুব্রত বর্মন স্ক্রীপ্ট হাতে অনুক্ষণ দন্ডায়মান থেকেছে কবিতা আবৃত্তির সময় আমাকে সহায়তা করার জন্য। ঢাকায় হয়তো আমার নাটকেও দর্শক হয়েছে। বলাবাহুল্য “দুই বিঘা জমি” কবিতাটির শুধু আবৃত্তিই নয়, অভিনয়ও করেছি, যাকে নাটকের সজ্ঞায় “ একক অভিনীত নাটক “ বা Dramatic Monologue বলা যেতে পারে। যেহেতু আরও অন্যান্যের সংলাপও রূপ দিতে হয়েছে । সন্যাসীরূপী উপেনের পোশাক ( Costume) পড়ে এই কবিতাটির রূপদান করাকে আমার কাছে মনে হয়েছে যে আমিই প্রথম। এর আগে আর কেউ এভাবে উপস্থাপন করেছে বলে আমার জানা নেই। তবে এই কাহিনী অবলম্বনে নাটক হয়ে থাকতে শোনেছি, আবৃত্তি নয়। তবে আমার ধারণা সত্য নাও হতে পারে। উপেনের জীবনের ট্রাজেডি তার নিজ মুখে হৃদয়বান দর্শকের কাছে উপস্থাপন করতে চেষ্টা করেছি। দর্শকগণও একাত্ম হয়ে গেছে আমার অভিনয়ের সাথে।
সুব্রত আমার সঙ্গী হয়েছে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের পিকনিকে। গিয়েছি আরও কত স্থানে। সেই হিসাবে আমার অসুস্থতাও হার মানে তার আমন্ত্রণের কাছে।
তার বিবাহ। বলতে গেলে পাত্রী পছন্দ করাও যেন আমারই দায়িত্ব। এক এক করে ছবি পাঠায় সে। আমাকে পছন্দ করে “ টিক” মার্ক দিতে হবে। কি কঠিন কাজ। অবশেষে চয়েস তো হলো। কিন্তু পাত্রীর সাথে সরাসরি কথা বলা। তাও হলো। শেষে এমন হলো যে, পাত্রী বোধ হয় প্রেম করছে দাদুর সাথেই, পাত্রের সাথে নয়। পাত্র-পাত্রী উভয়ের আবেদন এবং শেষে পর্যন্ত অভিবাবকদেরকে জড়িত করে নিমন্ত্রণ। উপায়ন্তর না দেখে আমি আমার ছেলেকে সাথে নিয়ে বিবাহের পর দিন বৌভাতে গিয়ে হাজির হই। তবে আমার যাবার কথা অনেকটা গোপন রেখেই গিয়ে হাজির হই। খুব খুশী হলো সবাই।
প্রথমে অপারগতা প্রকাশ করে ছিলাম এবং অপ্রত্যাশিত ভাবে হাজির হয়ে একটি চমকও দিলাম। ঠিক খাওয়া-দাওয়া চলার সময় টেবিলে গিয়ে বসে পড়লাম।
দেখা পেলাম একে একে ক্লাস ফ্রেন্ড, সিনিয়র ফ্রেন্ড জুনিয়র ফ্রেন্ড গণ্যমান্য ব্যক্তি, স্নেহাষ্পদ ও শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি আরও কতজনের । মিলে গেলো আন্তরিকতা পূর্ণ আরো বেশ কিছু নিমন্ত্রণ। অন্তত এক বেলা চারটে ডালভাত খেতে হবে এমন করে বলা। উপেক্ষা করে এমন সাধ্য কার। কিন্তু আমি হার্টের অপারেশন সহ এতো সব জটিল রোগে জর্জরিত যে, নিমন্ত্রণ রক্ষা আমার জন্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তারপরও দিনে তিন বেলাতো বটেই তারও বেশী সময় নিমন্ত্রণ খেতে হয়েছে। তাও মাংস ও মাছ বাধ্যতা মূলক। ছিল পায়েস দই মিষ্টি ইত্যাদি, যার সবই আমার জন্য বাতুল। কে শোনে কার কথা। এসব খাবারের বিরতিতে ফাঁকে ফাঁকে হালকা নাস্তা ,চা বিস্কুট ও রকমারি পিঠাও ছিল- যেখানে একান্তই খাবার খেতে অপারগ ছিলাম। আমার সাথে ছিল আমার মিত্র। ছাত্র জীবনে আমার প্রতিবেশী। অবস্থা সম্পন্ন এক কৃষক পরিবারের একজন শিক্ষিত ও রুচিশীল মানুষ। তিনি কবিতাও লিখেন চমৎকার। ওনার বাসায়ই আমাকে উঠতে হয়েছিল। তিনি প্রচন্ড কুয়াশার ভোরেও অনেকদুর এগিয়ে এসে আমাকে গ্রহন করেছিলেন। তাঁর ছেলে শংকরকেও মোটরবাইক নিয়ে আসতে বলে দেন। আমার মিত্র গজেন্দ্র চন্দ্র বর্মণ। উত্তরাঞ্চলে বিবাহ অনুষ্ঠানে মিত্র পাতা হয়। বন্ধু পাতা হয়। জলছিটা বেটা অথবা বেটি ,ইত্যাকার আত্মীয় পাতা হয়। এই আত্মীয়তার গভীরতা একবারে কোন হালকা সম্পর্ক নয়। অত্যন্ত গভীর। কোথাও কোথাও যেমন উকিল বাপ বানানোর প্রচলন আছে। সেই গজেন্দ্র চন্দ্র বর্মণ হলেন আমার মিত্র। তার বিবাহের সময় আমাকে মিত্র হতে হয়েছিল। আজও তা অমলিন। তিনিই আমাকে যখন নিজ বাড়িতে নিয়ে গেলেন আর সপরিবারে যে আন্তরিকতা দেখালেন এবং অভূতপুর্ব আন্তরিকতায় আপ্যায়িত করালেন তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আর এক বন্ধু সুসেন বর্মন, খুব করে ধরলেন যেন এক বেলা তাদের ওখানে খাওয়া-দাওয়া করি। আন্তরিকতার ছোঁয়ায ভরা বিভিন্ন আয়োজনে আমরা আপ্যায়িত হলাম সুসেন বাবুর বাড়িতে। গল্প হলো সন্ধ্যা অবদি। দুদিন যাবৎ আমাদেরকে অনুসরণ করে আসছিল অশ্বিনী । আমাদেরকে পেয়ে যারপর নাই খুশী। তারও ইচ্ছে অন্তত তার বাড়িতে যেন একটু বসি। অবস্থার দিক থেকে কিছুটা দুর্বল, শিক্ষার দিক থেকেও তাই। কিন্তু তাতে কি? তার আকাশচুম্বি ভালোবাসা আমাকে বিমূহিত করে। মিত্র ও অন্য একজন বিয়াই ( ভাতিজা মনীন্দ্র নাথের শ্বশুর) সহ গিয়েছি তার বাসায়। এমন আতিথেয়তা ভাষায় বর্ণনা করা আমার সাধ্য নয়। রাতে শোয়ার আগ পর্যন্ত প্রতি ঘন্টায় চলে আপ্যায়ণ। শারীরিক অবস্থার কথা তখন ভাবার সময় ছিল না। সত্যি উত্তরবঙ্গ খুব অতিথি পরায়ণ এবং মনের দিক থেকেও মানুষগুলো খুব সরল। তুলনা মূলক বিবেচনায় উত্তরাঞ্চলের অতিথি পরায়ণতার তুলনা মেলা ভার। খুবই অকৃত্রিম তাদের আন্তরিকতা। জনাব জালাল উদ্দিন মাহমুদ লিখিত রঙে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন এর ২য় খন্ডে “ অপূর্ব ভোজন “ পর্বটি পড়ে ছিলাম। মনে পড়ে গেল সেই চিত্রটি। সেটিও ছিল উত্তর বঙ্গের বেড়ের বাড়ি নামক গ্রামের আপ্যায়ণ । আমি সেটি মিলিয়ে দেখছিলাম আমার আপ্যায়ণের সংগে। সেই বেড়ের বাড়ির মালিক অতি ভোজনের বিড়ম্বনা হতে রেহাই পাবার জন্য কালি জিরা , আদা ও খাটি মধু খাবার যুক্তি দিলেন। তবুও খাবার সংক্ষিপ্ত করার পক্ষে মত দিলেন না। আমারও অনেকটা তাই হয়েছিল। সুব্রতর বিবাহ বাড়িতে দ্বিতীয় দফা খাওয়ার নিমন্ত্রণ। তাও সারতে হলো। পরেও আবার ডাক এলো , চা খাওয়া নাকি বাকি ছিল তার জন্য।
একাধিকবার এসে দেখা করেছিলেন বাবু রাধাবল্লভ রায়। রায় বাবু আমাদের রঙ লেপার একজন বড় অনুরক্ত, এবং এর সম্মানিত একজন উপদেষ্টা ও একজন প্রাক্তন শিক্ষক। কবিতা লিখেন ইদানিং। বার্ধক্য জনিত কারণে ভাল চলতে না পারলেও কষ্ট করে কয়েক বার এসে দেখা করেছেন। তবুও তাঁর অতৃপ্ত বাসনা লক্ষ্য করলাম যে, তিনি সময় অভাবে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আপ্যায়িত করতে পারেন নি আমাকে।
( চলবে)-
বাংলাদেশ সময়: ২০:০০:১৩ ● ৫০৭ বার পঠিত