টাইটানিক নামটি শুনলেই মনের মধ্যে শিহরণ বয়ে যাই মুহূর্তের জন্য । কেন ডুবে ছিল এই জাহাজ,কি-ই বা তার কারণ ? ১৯১২ সালের ১৫ এপ্রিলের প্রথম প্রহরে ডুবেছিলো টাইটানিক ৷ এর আগে ১৪ এপ্রিল মধ্যরাতের ঠিক আগে আইসবার্গের সঙ্গে ধাক্কা লাগে জাহাজটির। এর তিন ঘণ্টা পর জাহাজটি ডুবে যায় ৷ এই শত বছরে জাহাজডুবির আরও অনেক ঘটনাই ঘটেছে ৷ কিন্তু টাইটানিকের মতো কোনোটাই এতটা আলোড়ন তুলতে পারেনি ৷ এই এক জাহাজকে নিয়ে কত যে গান, কবিতা আর বই লেখা হয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই ৷ হলিউডে হয়েছে ব্লকবাস্টার ছবিও ৷ যে বছর টাইটানিক ডোবে সে বছরই কয়েকটি বই প্রকাশ পায় ৷ এরপর পঞ্চাশের দশকে টাইটানিককে নিয়ে বানানো হয় ‘এ নাইট টু রিমেম্বার’ নামের একটি ছবি ৷ সেসময় একটি বই’ও বের হয়েছিল ৷ এরপর ১৯৮৫ সালে আটলান্টিকের তলদেশে টাইটানিকের খোঁজ পাওয়ার পর আবার টাইটানিক নিয়ে আলোচনা শুরু হয় । আর ১৯৯৭ সালে জেমস ক্যামেরনের ‘টাইটানিক’ মুক্তির পর বিশ্বের সবার কাছেই পৌঁছে যায় এই জাহাজের গল্প ৷
‘টাইটান’ ছিল গ্রিক পুরানের শক্তিশালী দেবতা। তার নামানুসারে এই জাহাজের নাম রাখা হয়েছিল ‘টাইটানিক’। এটি আসলে জাহাজটির সংক্ষিপ্ত নাম। এর পুরো নাম ছিল ‘আর এম এস টাইটানিক’। ‘আর এম এস’ এর অর্থ হচ্ছে ‘রয়্যাল মেল স্টিমার’। অর্থাৎ পুরো জাহাজটির নাম ছিল ‘রয়্যাল মেল স্টিমার টাইটানিক’।
টাইটানিক জাহাজটির নির্মাণকাজ শুরু করা হয় ১৯০৭ সালে। পাঁচ বছর একটানা কাজ করে ১৯১২ সালে জাহাজটির কাজ শেষ হয়। হল্যান্ডের ‘হোয়াইট স্টার লাইন’ এই জাহাজটি নির্মাণ করেন। ৬০ হাজার টন ওজন এবং ২৭৫ মিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট জাহাজটি নির্মাণ করতে সে সময় খরচ হয়েছিল ৭৫ লাখ ডলার। ২৬৯ মিটার লম্বা, ২৮ মিটার চওড়া আর ৫৩ মিটার উঁচু টাইটানিক তৈরিতে খরচ হয়েছিল ১০ মিলিয়ন ডলার ৷ বর্তমানের হিসেবে সেটা প্রায় ২১৩ মিলিয়ন ডলারের সমান
৷ প্রস্তুতকারক কোম্পানি জাহাজে কোনো অ্যালার্ম সিস্টেম রাখেননি, কারণ টাইটানিক কখনো ডুববে না এমনটা ধরে নেওয়া হয়েছিল৷ প্রথম শ্রেণির টিকিটের মূল্য ছিল তখনকার দিনে ৪৪০০ ডলার৷ এখনকার দিনে যেটা প্রায় ৭৬ লক্ষ টাকার সমান ৷
১৪ই এপ্রিল দুপুর দুইটার দিকে ‘America’ নামের একটি জাহাজ থেকে রেডিওর মাধ্যমে টাইটানিক জাহাজকে জানায় তাদের যাত্রাপথে সামনে বড় একটি আইসবার্গ রয়েছে। শুধু তাই নয় পরবর্তীতে ‘Mesaba’ নামের আরও একটি জাহাজ থেকে এই একই ধরনের সতর্কবার্তা পাঠানো হয় টাইটানিকে। এ সময় টাইটানিকের রেডিও যোগাযোগের দায়িত্বে ছিলেন জ্যাক পিলিপস ও হ্যারল্ড ব্রীজ। দু’বারই তাদের দুজনের কাছে এই সতর্কবার্তাকে অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। তাই তারা এই সতর্কবার্তা টাইটানিকের মূল নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রে পাঠান নি। টাইটানিক দুর্ঘটনার মাত্র ৪০ মিনিট আগে Californian সিপের রেডিও অপারেটর টাইটানিকের সাথে যোগাযোগ করে আইসবার্গটি সম্পর্কে বলতে চেয়েছিল কিন্তু টাইটানিকের রেডিও অপারেটর ক্লান্ত জ্যাক পিলিপস্ রাগান্বিত ভাবে বলে “আমি কেইপ রেসের সাথে কাজে ব্যস্থ এবং লাইন কেটে দেয়।” ফলে Californian সিপের রেডিও অপারেটর তার ওয়ার্লেস বন্ধ করে ঘুমাতে চলে যায়। বলা চলে তাদের এই হেয়ালীপনার কারণেই ডুবেছে টাইটানিক।
টাইটানিক যখন দুর্ঘটনা স্থলের প্রায় কাছাকাছি চলে আসে। তখনই জাহাজের ক্যাপ্টেন সামনে আইসবার্গ এর সংকেত পান। আইসবার্গ হল সাগরের বুকে ভাসতে থাকা বিশাল বিশাল সব বরফখণ্ড। এগুলোর সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো, এগুলোর মাত্রই আট ভাগের এক ভাগ জলের উপরে থাকে। মানে, এর বড়ো অংশটাই দেখা যায় না। তখন তিনি জাহাজের গতি সামান্য দক্ষিণ দিকে ফিরিয়ে নেন। সে সময় টাইটানিকের পথ পর্যবেক্ষন কারীরা সরাসরি টাইটানিকের সামনে সেই আইসবার্গটি দেখতে পায় কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। টাইটানিকের ফার্স্ট অফিসার মুর্ডক আকস্মিকভাবে বামে মোড় নেওয়ার অর্ডার দেন এবং জাহাজটিকে সম্পূর্ণ উল্টাদিকে চালনা করতে বা বন্ধ করে দিতে বলেন। টাইটানিককে আর বাঁচানো সম্ভব হয় নি। এর ডানদিক আইসবার্গের সাথে প্রচন্ড ঘষা খেয়ে চলতে থাকে। ফলে টাইটানিকের প্রায় ৯০ মিটার অংশ জুড়ে চিড় দেখা দেয়। টাইটানিক জাহাজটি যেই স্থানে ডুবেছিল সেই স্থানের নাম হলো ‘গ্রেট ব্যাংকস অফ নিউফাউন্ডল্যান্ড’। টাইটানিক সর্বোচ্চ চারটি জলপূর্ণ কম্পার্টমেন্ট নিয়ে ভেসে থাকতে পারতো। কিন্তু জলপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল ৫টি কম্পার্টমেন্ট। এছাড়া জল প্রতিরোধ এর জন্য ১২টি গেট ছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে এমন জায়গায় জাহাজটির ধাক্কা লাগে যে, সবগুলো গেটের জল প্রতিরোধ বিকল হয়ে যায়। জলের ভারে আস্তে আস্তে জলে তলিয়ে যেতে থাকে টাইটানিক। রাত ২ টা থেকে ২ টা ২০ মিনিটের মধ্যে টাইটানিকের সম্পূর্ণ অংশ আটলান্টিকের বুকে তলিয়ে যায়। ডুবে যাওয়ার শেষ মুহূর্তে জাহাজের বৈদ্যুতিক সংযোগ বিকল হয়ে যায়। টাইটানিক যখন সমুদ্রের বুকে তলিয়ে যায় ঠিক তার এক ঘণ্টা ৪০ মিনিট পর রাত ৪ টা ১০ মিনিটে সেখানে আসে ‘দি কারপাথিয়া’ নামের একটি জাহাজ। জাহাজটি সমুদ্রের বুকে ভেসে বেড়ানো ৮০০ জন যাত্রীকে উদ্ধার করে সকাল সাড়ে আটটার দিকে নিউইয়র্কে চলে যায়।
টাইটানিকের সেই অতীতকে প্রথম খুঁজে বের করেছিলেন রবার্ট ব্যালাড নামে এক সমুদ্রবিদ। সময়টা ১৯৮৫৷ তার আগে যারা টাইটানিকের খোঁজ করেছিলেন, সকলেই গভীর পানিতে খুঁজেছিলেন ৷ কিন্তু সেখানে তো নেই টাইটানিক৷ যেহেতু তার আকৃতিটা বিশাল, তাই সকলেরই ধারণা হয়েছিল, টাইটানিক নিশ্চয়ই অনেক গভীর জলেই ডুবেছে৷ কিন্তু আসল ঘটনা হয়েছিল অন্য ৷ সমুদ্রের মাত্র ৩৮০০ মিটার নীচে ছিল টাইটানিক ৷ সমুদ্রতলের নীলাভ আলোয় বিখ্যাত জাহাজটিকে দেখে এসে তার খবর জানান গোটা বিশ্বকে ৷ ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এর নিদারুণ ফলাফল এই টাইটানিক । অনেকেই মনে করেন অলৌকিক কোন ক্ষমতাই টাইটানিকের এই পরিণতি । কিন্তু এই কথার কোন ভিত্তি নেই বলে দাবী বিজ্ঞানীদের।
সংকলনেঃ মাসুম আজাদ