কবি ও সাহিত্যিক খাতুনে জান্নাত ভালোবাসেন মানুষ ও প্রকৃতি; দুর্বলের প্রতি সহিংসতা ও অভিন্নতার মুক্তি চান তিনি। তাঁর কবিতা নস্টালজিক অনুভূতি, নারী মুক্তি, প্রকৃতি, বোধ ও বিভেদমুক্তির ও উজ্জীবন মূলক।
কবির জন্ম সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার, ঘিলাছড়া ইউনিয়নে। তবে তাঁর পৈতৃক ও মাতৃক ঠিকানা: লক্ষ্মীপুর জেলাধীন লক্ষ্মীপুর থানার গোপীনাথপুর গ্রামে।
জন্ম ও শৈশব :
ফেঞ্চুগঞ্জের গোয়ালটিলায় ১৯৬৯ সালের ১২ জুলাই ইং ও ২৮ আষাঢ ১৩৭৬ সাল সকাল ৯টায় বৃষ্টিস্নাত দিনে জন্মগ্রহণ করেন। মাতা গোলেয়ারজান বেগম ও পিতা: শামছুল হুদা মিঞা। পিতা ছিলেন বৃটিশ সৈনিক ও পরবর্তীতে ফুড ইন্সপেক্টর। পিতার চাকরিসূত্রে ফেঞ্চুগঞ্জে অবস্থান। ৯ ভাইবোনের কবি ৮ম।
১৯৭৩ সালে লক্ষ্মীপুরের গোপীনাথপুর গ্রামে ফিরে আসেন।
শিক্ষা:
১৯৭৫ সালে পূর্ব গোপীনাথপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৯৮০ সালে খিলবাইছা বালিকা বিদ্যা নিকেতনে ও ১৯৮৩ সালে খিলবাইছা জি.এফ.ইউ উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৮৫ সালে এস.এস.সি বিজ্ঞান বিভাগে (প্রথম বিভাগ) পাশ করেন। ১৯৮৮ সালে ইডেন মহিলা মহাবিদ্যালয় থেকে এইচ.এস.সি বিজ্ঞান ( ২য় বিভাগ), বদরুদ্দোজা মহিলা মহাবিদ্যালয়ে বিএসসি ভর্তি হলেও বৈবাহিক কারণে পরীক্ষা দেয়া হয়নি। পরবর্তীতে ১৯৯৫ সালে মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেন।
লেখা:
১৯৮৯ সালে প্রথম প্রকাশিত ‘বৃষ্টি’ ছড়া প্রকাশিত হয় ‘দৈনিক পত্রিকা’ নামক দৈনিকে। এরপর ইত্তেফাকসহ অনেক পত্রিকায় ছড়া, কবিতা প্রকাশিত হয়। একই পত্রিকায় ‘নুরি’ শিরোনামের গল্প। তারপর দীর্ঘদিন বিরতি। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরের ১১ তারিখ বিলাতে গমন ও ২০০৮ সাল থেকে বিলাতে ‘সংহতি বাংলা কবিতা উৎসব’কে কেন্দ্র করে লেখা শুরু করেন। তারপর থেকে লিখছেন নিয়মিত। এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৭। যৌথ গ্রন্থের সংখ্যা অসংখ্য।
গ্রন্থ:
কবিতাগ্রন্থ: দিনান্তে দেখা হলে (২০০৯) জীবনের কাছে ফিরে (২০১০), নিরন্তর রোদের মিছিলে (২০১২), মুঠো খুলে দেখি(২০১৬), নিসর্গে নিমগ্ন নামতা(২০২২),
উপন্যাস গ্রন্থ:শিউলির কথা (২০১৯), বিলেতের বাউরি বাতাস(২০২২)।
নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ গ্রন্থ‘ দ্য রে অফ লাইফ এন্ড নেচার‘ প্রকাশিত হয় ২০১৩, অনুবাদ ব্রজেন চৌধুরী।
লিটলম্যাগ ও জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত লিখছেন। বাংলাদেশ ভারত, যুক্তরাজ্যসহ,যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের জাতীয় দৈনিক, ব্লগ ও অনলাইন পত্রিকায় বাংলা ও ইংরেজি কবিতা, গল্প, উপন্যাস, অনুবাদ, প্রবন্ধ ও তাঁর কবিতার ইংরেজি অনুবাদ কবিতা প্রকাশিত হচ্ছে।
গান, শিশুতোষ ছড়া, সাহিত্য ও নারী বিষয়ক প্রবন্ধ ও নিবন্ধ লিখছেন বর্তমানে করছেন অনুবাদ।
কবির কবিতাগ্রন্থ ও কবিতা নিয়ে এ পর্যন্ত লিখেছেন বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিকগণ। আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, মহাদেব সাহা, কেতকী কুশারী ডাইসন, সালেহা চৌধুরী, অলোক কুমার বসু, গোলাম কবির, নুরুজ্জামান মনি, হামিদ মোহাম্মদ, সন্দীপক মল্লিক, হাসান ওয়াহিদ, তুষার কবির, মণীষ চক্রবর্তী প্রমুখ।
পুরস্কার:
কৃত্তিবাস স্মারক সম্মান ২০১২(পশ্চিম বঙ্গ, ভারত), লক্ষ্মীপুর জেলা সাহিত্য সংসদ পুরস্কার ২০১৫,কবিবরণ সম্মাননা ২০১৬( মাতৃভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র, বিশ্ব শান্তি পদক ২০১৮(বাংলাদেশ ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্র), ভাসানী গোল্ড মেডেল ২০১৮(ভাসানী ফাউন্ডেশন)। বিভিন্ন সামাজিক ও সাহিত্যিক সংগঠনে বিশেষ অতিথির স্মারক সম্মান পেয়েছেন। বেতার বাংলা ২০১০, ২০১১ যুক্তরাজ্য, বাংলাদেশ টেলিভিশন(২০১৪), দক্ষিণ বাংলা, ভারত (২০১৬) নিউজ এক্সপ্রেস ভারত(২০১৬) টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার ও সাহিত্য আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছেন। অনলাইন টেলিভিশন ও পত্রিকায় সাহিত্য ও মানবাধিকার বিষয়ক আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছেন।
সংগঠন:
সংহতি লিটারেরি অর্গানাইজেশন,প্রগতি লেখক সংঘ
প্রকাশক: আলোকন, মানবাধিকার ও সাহিত্য পত্রিকা।
পেশা:
খাতুনে জান্নাত পেশায় শিক্ষক ও প্রশিক্ষক ছিলেন। ইংরেজির শিক্ষক হিসাবে ঘুঙ্গাদিয়া গার্লস হাইস্কুল ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল বিবিআইএ(বৃটিশ বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল একাডেমি) তে শিক্ষকতা করেন (২০০১-২০০৬)।
অভিজ্ঞতা:
প্রশিক্ষণ অফিসার (১৯৯৫-১৯৮৮) ও স্পেশাল প্রশিক্ষক(২০০৬-২০০৭) হিসাবে এনজিও ডরপ (ডেভেলপম্যান্ট অরগানাইজেশন অব দ্য রুরাল পুয়র) এ কাজ করেছেন।
জিগাতলা মহিলা উন্নয়ন সমিতির জেনারেল সেক্রেটারি (১৯৯৪-১৯৯৬) ছিলেন।
বর্তমান পেশা:
উদয়াঙ্গন সমাজ উন্নয়ন সংস্থার(১৯৯৮-) জেনারেল সেক্রেটারি ও
ডিআরএমসি (ডেভেলপম্যান্ট অরগানাইজেশন অব দ্যা রুরাল মাদার এন্ড চাইল্ড)
(১৯৯৮-) এর জেনারেল সেক্রেটারি ও অফিস প্রধান হিসেবে কাজ করছেন। নারী উন্নয়ন, মা ও শিশু স্বাস্থ্য, দক্ষতা উন্নয়ন বিষয়ে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন।
প্রশিক্ষণ:
মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তির বিকাশ( স্পার, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত) মানবাধিকার উন্নয়ন(কারিতাস বাংলাদেশ) মানব সম্পদ উন্নয়ন, প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা(এএলআরডি), আইন ব্যবস্থাপনা, দক্ষতা উন্নয়ন( কার্টিং ও টেইলরিং, বাটিক, ফেব্রিক্স, ব্লক প্রিন্টিং, স্ক্রিন প্রিন্টিং, দেশি ও বিদেশি রান্না, বোতলজাত খাবার হাঁস মুরগী পালন) দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা(বিডিপিসি), উপানুষ্ঠানিক ও ব্যবহারিক সাক্ষরতা(এফআইভিডিবি, সিলেট ও ডরপ), আয়বৃদ্ধিমূলক প্রকল্প গ্রহণ ও ব্যবস্থাপনা(কেয়ার বাংলাদেশ), জেন্ডার রিলেশন(ঊষা)
সখ: তৈলচিত্র অঙ্কন
. ছন্দ ও অলঙ্কারের গাঠনিক বিন্যাসে তাঁর কবিতা সুখপাঠ্য ও গভীর ভাবের দ্যোতনায় আবিষ্ঠ। কবি খাতুনে জান্নাত কবি হিসেবে যেমন কাব্যপ্রেমী পাঠকের কাছাকাছি চলে এসেছেন, তেমনি সাহিত্য-বোদ্ধা বিদগ্ধ জনেরও দৃষ্টি আবর্ষণ করেছেন। তাঁর সাহিত্যকর্ম বিশালতায় ব্যাপ্ত না হলেও ইতোমধ্যে তিনি যতটুকু দিতে পেরেছেন তা অকিষ্ণিৎকর নয় সুধীজনের দৃঢ় বিশ্বাস, খাতুনে জান্নাতের হাত দিয়ে আসবে আরও নতুন সাহিত্য-সওগাত। তাই তো তাঁর সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক ও সমালোচক বুদ্ধিজীবীগণ তাঁদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। তাঁর প্রকাশিত বই নিয়ে আলোচনা করেছেন। এসব আলোচনার মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে এসেছে আধুনিক কাব্য-সাহিত্যে খাতুনে জান্নাতের প্রতিশ্রুতিশীল অভিজ্ঞান। তাঁদের সুচিন্তিত মতামত থেকে কিছু অংশ তুলে ধরা হলো…
আব্দুল গাফফার চৌধুরী
প্রখ্যাত সাহিত্যিক-সাংবাদিক, খ্যাতিমান কলাম লেখক,‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ অমর গানের রচয়িতা আদুল গাফফার চৌধুরী বলেন–খাতুনে জান্নাত বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের একেবারেই নতুন এক কবি। তাঁর এবং তাঁর কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় আকষ্ণিক।কিন্তু তাঁর সমাজচিন্তা ও ব্যক্তিগত ভাবনা যখন জাগতিক স্থূলতা পেরিয়ে পাঠকের সূক্ষ্ন মননে আঘাত করে, তাকে সুপ্ত অথবা উদ্দীপ্ত করে, তাকে স্বসময়ের বাইরে অনাদি আধুনিকতার স্পর্শ দেয়, তখন বিস্মিত হয়েছি। তার কবিতা প্রথাগত চিন্তার নয়, একেবারে প্রথাগত আঙ্গিকেরও নয়। তার কবিতায়ব্যক্তি মনের যন্ত্রণার সঙ্গে যুগযন্ত্রণাও আছে। কিন্তু প্রকাশটি কাব্যিক। তা অকাব্যিক শ্লোগান হয়ে উঠেনি। এ জন্যই তার কবিতা পাঠকের মন স্পর্শ করার ক্ষমতা রাখে।তার কবিতার এ যাদুস্পর্শ আমি পেয়েছি এবং বিস্মিত হয়েছি।আমার ধারণা তিনি বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের কবিতার আকাশে একটি উল্কা হয়ে থাকতে না চাইলে একদিন নক্ষত্র হয়ে উঠতে পারবেন।
মহাদেব সাহা
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি মহাদেব সাহা বলেন, খাতুনে জান্নাত তার কবিতায় জীবনকে নানা মাত্রায় অনুভবের চেষ্টা করেছেন। তার সেই অনুভব যে কবির অনুভব, তা স্বীকার করতে হয়। এখানে জীবনের বহুতল স্পর্শ করার চেষ্টা যেমন রয়েছে তেমনি আছে নিজেকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ ও উন্মোচনের প্রয়াস। এ কাজে তাকে আমার সাহসী বলেই মনে হয়। কিছু কিছু কবিতার শব্দ ব্যবহারে, ব্যঞ্জনা ও চিত্রকল্প সৃষ্টিতে তার এ শক্তি ও সাহসের পরিচয় আছে। তার অনেক কবিতার অন্তর্নিহিত দ্যুুতি যে সহজেই চোখে পড়ে, তা তার নিজস্বতারই পরিচয়। তার কবিতা পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে তার একটি চমৎকার কবিমন আছে যা নিয়তই জীবন ও জগতের রহস্য সন্ধান করে, জীবনের সব স্তর উপলব্ধি করতে চায়। যেকোন কিছুকেই কবিতা করে তোলার একটা সহজাত ক্ষমতা তার মধ্যে। তার কিছু কিছু কবিতা অন্তরস্পর্শী একইসঙ্গে সাবলীল।–অসংকোচে প্রকাশের একটা দৃঢ়তাও আছে তার মধ্যে যা সবার থাকে না।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
উভয় বাংলার জনপ্রিয় সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় খাতুনে জান্নাত সম্পর্কে বলেন ‘‘খাতুনে জান্নাত প্রবাসে থেকেও বাংলায় কবিতা লিখছেন। এই প্রচেষ্টা অবশ্যই অভিনন্দনযোগ্য। তাঁর কবিতায় উঠে আসে প্রেম, প্রকৃতি এবং হারিয়ে যাওয়া ভিটে মাটির জন্য বেদনা। তার কণ্ঠস্বর আন্তরিক। আমি তার উজ্জ্বল ভবীষ্যৎ কামনা করি।
কেতকী কুশারী ডাইসন
কবি-সাহিত্যিক, সমালোচক, গবেষক কেতকী কুশারী ডাইসন বলেন, কবি হিসাবে তার মধ্যে প্রতিশ্রুতি আছে। জীবন সংগ্রামের নানা খাতে কবিতাই অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। বিষয়বৈচিত্র, সংবেদন, প্রকৃতি আর মানুষের সাথে মিথস্কিয়ার প্রতিবেদন, ভাষাচেতনা, ছন্দের দোলা, শব্দদের নিয়ে কারুকাজ-নানা দিক দিয়ে তার বই আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। কবি হিসেবে তার বিবর্তনের জন্য চাই সে সামর্থের বিকাশ,বিবর্ধন ও পরিশীলন- মূলধনকে না হারিয়ে নূতন বৃদ্ধি। তাঁর অনেক কবিতা আমার প্রিয় কবিতার তালিকায় উঠে এসেছে।
নুরুজ্জামান মনি
সাংবাদিক, কবি গীতিকার নুরুজ্জামান মনি বলেন–কবি খাতুনে জান্নাত শিখে নিয়েছেন ব্যক্তিগত অভাববোধকে কী করে সামাজিক যন্ত্রণায় পরিণত করা যায়। কী করে সমাজ ও ব্যক্তির স্হূল ভাবনা ও আচরণকে বাগদেবীর সূক্ষ্ন বীণার তারে ঝংকৃত করে তোলা যায়। প্রথম কাব্যগ্রন্থে তার ছাপ পাওয়া যায়।তিনি আরও বলেন, খাতুনে জান্নাত নিজেকে তৈরী করেই কবিতা লিখতে শুরু করেছেন। বিশুদ্ধতা, উদারতা আর প্রগতীশীলতার আদর্শ আর বিশ্বাস দিয়ে গড়া তাঁর মনোজগৎ। তিনি চান শুদ্ধ মানবিকতার উদার একটি আকাশ। যে আকাশে থাকবে না কোন অশিক্ষা-অজ্ঞানতার অন্ধকার। ধর্মের ভেদ রহিত হবে মানুষের মন থেকে।তাঁর আহ্বান–বাঙালি নারীদেরকে এগিয়ে আসতে হবে চির অবরোধের দেয়াল ভেঙে, হতে হবে আত্মনির্ভর।
সালেহা চৌধুরী
সাহিত্যিক, আলোচক সালেহা চৌধুরী বলেন, খাতুনে জান্নাতের কিবিতায় তার নিজস্ব চিন্তা রয়েছে। আমরা সবসময় মৌলিক চিন্তার কাছে কৃতজ্ঞ। তাঁর লেখার কৌশল ও বিন্যাস সুন্দর। তিনি পরীক্ষা নীরিক্ষা নিয়ে ভাবেন না, কবিতার শর্ত মানেন।যথাযথ শব্দ, ভাব, প্রতীক,দৃশ্যকল্প,উপমা,উৎপ্রেক্ষার বিন্যাসে তার কবিতা সত্যিই মনোগ্রাহী ও হৃদয়গ্রাহী হয়ে ওঠে। তার কবিতায় দুঃখ আছে, মৃত্যু আছে তারপরও জীবন থাকে। যেখানে জীবন-পিপাসা স্পষ্ট, আশাবাদও বেশ পরিষ্কার। তার কবিতা পড়তে পড়তে ধ্যানস্থ হয়ে যাই।
তিনি আরও বলেন–ছাই দিয়ে ঢেকে রাখলেও সত্যিকারের মনিমুক্তা যেমন চাপা থাকে না তেমনি চাপা থাকেনি খাতুনে জান্নাতের অসাধারণ কাব্য প্রতিভা। কবিতার তিনি ইতিমধ্যেই স্বতন্ত্র পরিচয়ে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছেন। তার কবিতা সহজ, গভীর ও স্বতন্ত্র।
অলোক কুমার বসু
কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক অলোক কুমার বসু বলেন-খাতুনে জান্নাতের সবচেয়ে অর্জন এই যে, তার গদ্যধর্মী ও বিমূর্ত চিন্তা নিছক বিবৃতি হয়ে থাকেনি। তা কবিজনোচিত অনুভূতির প্রসাদে রীতিমত কাব্যধর্মী ও সাবয়ব। সার্থক কবিতার জন্ম স্থির-আত্মস্থ মননে। খাতুনে জান্নাতের কবিতায় অনুভূতির প্রকাশের সঙ্গে এই মননের লক্ষন পরিস্ফুট। ব্যক্তিগত অনুভূতির নৈব্যক্তিক বর্ণনায় তার কবিতা উত্তীর্ণ বলা যায়।
গোলাম কবির
কবি ও সংস্কৃতিকর্মী গোলাম কবির বলেন,একজন নবাগত কবি যে এতখানি সমৃদ্ধি নিয়ে বৃটেনে বাংলা কবিতার ভুবনে আবির্ভূত হতে পারেন, তাতেই আমার বিস্ময়।একই সঙ্গে আমি আনন্দিত এই জন্যে যে, তাঁর মতো একজন মেধাবী এবং অনহঙ্কারী সদালাপী মিশুক কবিকে পেয়েছি আমাদের কবিদের আঙিনায় এবং আড্ডায়।
তিনি আরও বলেন, কবি খাতুনে জান্নাতের কবিতা বিশেষত্ব পায় মূলত প্রগতিশীলতায়। আবার তার সঙ্গে রয়েছে তার স্মৃতিময় শৈশব-কৈশোর-যৌবনের ঘাত-প্রতিঘাতে তিক্ত সুখ-দুঃখময় অভিজ্ঞতা। এ বিষয়গুলো মোটামুটি তার কবিতায় ফুটে ওঠে বলেই পাঠক তার কবিতা পড়তে গেলে একেবারেই সাম্প্রতিক সময়ের গ্রামবাংলার সামাজিক চিত্রকে খুঁজে পাবেন।এখানেই একজন সাহিত্য স্রষ্টার পরিতৃপ্তি।
কবি খাতুনে জান্নাতের কবিতা ভালো লাগার কবিতা। কবি হিসেবে তিনি স্বভাব কবির মতোই প্রতিভাত হচ্ছেন আমার কাছে। তার এই প্রতিভা ক্রমশঃ প্রস্ফুটিত হবার লক্ষন রাখে। তার কাব্যমানের বিচরণ ভূমি অতীব সরস। এখন শুধু তাকে হতে হবে পরিশ্রমী কৃষক।
সন্দিপক মল্লিক
কবি খাতুনে জান্নাত কবিতায় জীবন পূর্ণতার জ্যোতিকেই লালন করেন। তাঁর শিল্পবোধ এবং জীবনায়োজনের বৃত্ত বিন্যস্ত হয় সত্যায়ত রূপমায়। দেশ-কাল-বোধের পরিচ্ছন্ন চিত্রদীপ্তি সম্যকভাবে সংবৃত হয় তাঁর কবিতায়। উপযুক্ত শ্রীমগ্ন অনুভাবনায় ‘সত্য’ই সংস্থিত। শব্দ-সত্য-জ্যোতির্ময় কবি জীবন- বিশ্বস্ততার আল্পনা এঁকেছেন অবলীলায়। জয়শ্রীমান দেশদীপ্তি আর জীবন সৌন্দর্যের সন্দীপ্তি কবির সৃজন পরিব্যাপ্তিতে। সত্তার পুলক সঞ্চারী উপমা আর উৎপ্রেক্ষার ফাগুন, ছন্দ, -মাধুর্যমন্ডিত অন্তমিল দিব্যশ্রীমান হয়েছে কবির শিল্পায়নে।অপরূপ প্রেমাত্মক কবির শব্দ-সন্দীপনার বৃত্তায়ন। বাক্যময় অনুভব - সুষম প্রিয় সান্নিধ্যযাপন - যৌবন মদিরতা! কবির প্রাণ- সম্পুষ্ট শিল্পানুগ দিশা কষ্ট বেদনার বৃত্ত অতিক্রমী। কবি তো স্বার্থান্ধ ‘শিয়াল’ কে পশ্চাতে ফেলে লুকনো আতরের আবাসন গড়তে আগ্রহী। প্রেম-অন্বীক্ষুমুগ্ধতায় তাঁর কবিতালাপ সজ্জিত হয় হৃদয় মোহন ভঙ্গিমায়। কবির মনন স্পন্দনে উত্তরাধুনিকতার রূপান্বয় আর লোকজ সংবৃত্তির সুধা। উদ্দেশ্য শান্তি, স্বধা আর স্বস্তি। যতোই বেদনার্ত হোক অস্তিত্ব; বস্তু জাগতিক অপঘাতে শোষণে যতোই বিধ্বস্ত হোক সত্তার সজ্জাপ্রভাত-প্রশান্তি আর প্রাণ-প্রেম সুষমাই কবির প্রার্থিত। যা সাার্বজনীন। সর্বাত্মক স্বস্তির আরাধনায় পল্লী সৌন্দর্যের আনুপূর্বিক অন্বেষায় কবির কবিতা-জ্যোতির্ময় অনুভব অনুবন্ধের আয়োজন। কবির অনুভবের বিস্তারণ, সূক্ষ্ন সমুজ্জ্বল সত্যাহরণ, প্রবুদ্ধ বিচক্ষণতা, মনস্বিতা- সমৃদ্ধি অতুল্য। কবি সম্পূর্ণ জীবনেরই সম্পোষক। পূর্ণতার চন্দন শুদ্ধতাই তার প্রাপ্তব্য। যা সার্বজনীন পূণ্যের আধার।
তুষার কবির
কবি খাতুনে জান্নাতের কবিতা—পাঠ সারাৎসারে বলা যায়—সহজ, সরল, স্নিগ্ধ, আটপৌরে শব্দে ভরা, যাপিত জীবনের টুকরো টুকরো অনুষঙ্গে ঠাসা! অহেতু জটিলতার পথ পরিহার করে তিনি লিখে চলেছেন মুঠো মুঠো পংক্তিগুচ্ছ—যা পাঠকের সাথে কমিউনিকেট করে সহজেই। ‘‘সহজ লোকের মত কে চলিতে পারে’’—কবি জীবনানন্দ দাশের এই সরল জিজ্ঞাসার উত্তর দিতেই যেনবা খাতুনে জান্নাত সহজভাবেই হেঁটে চলেছেন কবিতার পথে।তাঁর বই পড়তে পড়তে যে কথা সবার আগে মনে হয়েছে তা হল তিনি শব্দ নিয়ে খেলা করতে ভালোবাসেন। শব্দকে নেড়ে চেড়ে, ছেনে, উল্টেপাল্টে সৃষ্টি করেন খণ্ড খণ্ড কবিতা-প্রিজম! ‘শব্দ হাতে পেলেই আমি খরচা করে ফেলি’—কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের এ পংক্তিঘোরে মনে হয় খাতুনে জান্নাত মোহাচ্ছন্ন! তাই তো ‘কবির পংক্তিতে পংক্তিতে উঠে আসে খৈ-রঙা বিকেল, বাতাসে ঘি-পোড়া গন্ধ, লুটানো ঘুঙুর, সরোদ ও মৃদঙ্গের টুংটাং, গোছানো বিষাদ, ইন্দ্রিয়ের অনুষ্টুপ, চিরহরিৎ রক্ত, আতপ জীবন, জলের জারক—এরূপ বহুবর্ণিল উপমা, রূপক ও চিত্রকল্প! খাতুনে জান্নাত বাগ্দেবীর আরাধ্য আশ্রমের দিকে হেঁটে চলেছেন। তবে এই পথ চলায় তাকে মগ্ন হতে হবে বিস্তর পঠন-পাঠনে, নিজস্ব ক্র্যাফ্টম্যানশিপে, ভিন্ন কোনো ইশারা লিখনে!
হাসান ওয়াহিদ
খাতুনে জান্নাতের কবিতাভূবন বৈচিত্রময় ও প্রাণশীল। তিনি জীবনটাকে কবিতার মধ্য দিয়েই দেখেন। আমাদের চোখে তাঁর অস্তিত্ব কবিতা হয়েই ভেসে ওঠে। তিনি কবিতার মধ্যে দিগন্তের দিকে ঢেউ খেলানো অদৃশ্য বাতাসকে খোঁজেন। কবিতার সংজ্ঞা কী? এক কবি থেকে আর-এক কবির কাছে কবিতার সংজ্ঞায় কোনো মিল নেই, অথচ আমরা সমবেতভাবে কবিতা ব্যাপারটা কী তা বুঝি, অকবিতা থেকে তাকে আলাদা করে নিতে পারি। একারণে আমরা ভালো কবিতা খারাপ কবিতা নিয়ে তর্ক করতেও উদ্যত হই। এই বিতর্কে দেখা যায় অনেকেই আলাদা, আবার সবাই কোথাও গিয়ে এক।
খাতুনে জান্নাতের কবিতা, তাই স্ব-স্পর্শকারী, আত্মমুখী, নিটোল ও সুন্দরাভিসারী। তিনি কবিতাবিশ্বকে তাঁর নিজস্ব ও নির্জন করে গড়ে তুলেছেন। তিনি কবিতার মধ্যে যুক্ত করেন ও যুক্ত থাকেন বিবিধ কবিতার ভাষাসাজের ঐতিহ্যের সঙ্গে। একটি সার্থক কবিতাপাঠ আসলে পাঠকেরও দায়িত্ব বাড়ায়। কবিতার মধ্য দিয়ে একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম দেয়া কবিকে খুঁজে পান পাঠক। খাতুনে জান্নাতের কবিতা তাই কবিতা আচরণকারীদের সুখপাঠ্য।
মণীষ চক্রবর্তী
খাতুনে জান্নাত
আড়ালে থাকা এক কবি. ইংরেজীতে একটা কথা আছে Red Letter Day. বাংলায় তার মর্মার্থ ঠিক জানিনা । তবে আমার একটি দিনের কথা মনে পড়ে । সেদিন হাতে প্রচুর সময় ছিল । বাংলা কবিতার একটি জনপ্রিয় ওয়েব সাইটের বর্তমান কালের কবিদের লেখা কবিতা পড়ছিলাম । পড়তে পড়তে হঠাৎই একটা কবিতায় এসে দাঁড়িয়ে যেতেই হল। কবিতার নাম ‘দাগ’। কবি ‘খাতুনে জান্নাত’ । তখনও পর্যন্ত আমার কাছে অজানা অচেনা এক কবি ।
কবিতাটি সেদিন কম করে হলেও চল্লিশবার পড়েছি । আখমাড়াই কলের মতোই পিষে ফেলছিলাম কবিতাটি । এ এক অপূর্ব নতুন স্বাদ, অনন্য অনুভূতি। প্রতিটি শব্দে নেশা আছে । দাগ আমাকে গভীরভাবে দেগে দিয়ে গেল ।
একে একে কবির প্রায় শতাধিক কবিতা পড়ে ফেললাম । একটু একটু করে মনের ক্যানভাসে ফুটে উঠতে থাকে এক স্বভাবলাজুক কবির চিন্তা, চেতনা, আত্মনিমগ্নতা। কোথাও বা জীবনের প্রতি দ্বিধা-দ্বন্দ্ব । (” আগুনপোড়া হাত আগুন কিভাবে নেভায়!”- জীবনপাঠ )
কাব্যের পরতে পরতে খুলে যায় মানুষের চিরন্তন প্রেম ও যৌনতা । এখানে তাদের দেখি এক অনুপম রূপে । এই সৌন্দর্য এক বিমূর্ত শিল্পকর্ম । উন্মাদনা আছে । পাশবিকতা নেই । এখানে আত্মবিশ্বাস ও স্বাধিকারবোধ নিজের নিজের সীমাবদ্ধতায় সচেতন । দান নেই ।সমর্পণ আছে । কেড়ে নেওয়া নেই । আমৃত্যু প্রতীক্ষা আছে ।
(”উষ্ণতা বেয়ে উষ্ণতা উঠে যায়
কোষ কলায় সঞ্চারী ধারাপাত”… যুবতী জ্যোৎস্নায়)
আমি বামেও আছি, জিরাফেও আছি । কালচক্রে আছি। আছি আবার নির্বাণেও । হ্যাঁ, ঠিক বলছি । এ পৃথিবীতে অধিকাংশ জীবন এভাবেই বয়ে চলে । তাই যখন কবি বলেন ,”গাছের ডালে ঝুলছে ঘুড়ি, চামচিকা
মিলে মিশে থাকে মুক্তি- বদ্ধতা”(কবিতা -ব্রীজ )- যেন সেই কালজয়ী সত্য পুনর্জন্ম নেয়।
যুগে যুগে দেখেছি হৃদয়ের গভীরে সুপ্ত বিশ্বাস আর চেতনার চোখ দিয়ে দেখা নুতন নিষিক্ত স্বপ্ন বিপ্লবের জন্ম দেয় । জন্ম দিতে গিয়ে দেখি আমাদের চোখের আড়ালে কত স্বপ্ন হয়েছে গতানুগতিক হাঁসেদের চোখে মৃতবৎস্যা । বোঝে না লোকে তবুও তো একটা সৎ প্রচেষ্টা ছিল । তাদের প্রসববেদনা আজও মিথ্যে কথা বলে না । (সাংসারিক হাঁস গড়িয়ে গড়িয়ে হাসছে… ঠকবাজ)।
বিজ্ঞাপণ বর্তমান সভ্যতায় যেন উৎকর্ষের বিচারের মাপকাঠি হয়ে উঠেছে । পেশাদার বিজ্ঞাপণদাতাদের সৌজন্যে অনেক সময়ই দেখা যাচ্ছে কাঁচের টুকরোয় হীরের চমক । এই প্রচার বিমুখ হীরে তাই জহুরীর নজরে আজও তেমনভাবে পড়েনি। অবশ্য শুনেছি পরিবেশ দূষণ ও ভিটামিন এ’র অভাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জহুরীরা আজকাল আর ঠিক করে আগের মতো দেখতে পান না ।
কবিতার মাঝে কখনো রক্ত মাংসের মানুষ কবিকে খুঁজতে চাওয়া ঠিক নয় । প্রতিটি কবিতার পোশাকে সে ধরা দেয় নিত্যনতুন সাজে । কবিতার খাতা থেকে উঠে আসা কোনো প্রতিমূর্তি যার সাথে কোনো সামাজিক আটপৌরে সম্পর্কে বাঁধা পড়ে না গতানুগতিক জীবন ।
যে পাখী গাইছে পাতার আড়ালে বসে
কোনো উদাসী স্বপ্নাহত হৃদয়ের কথা
কখনো দেখিনি আমি চোখ তুলে
তার ভাঙা নীড়ে শ্রাবণের স্রোতধারা ।
পৌষালী কুয়াশার আবছা চাদরে ঢেকে
তবুও কী গভীরতম ভালোবেসে জীবনকে
ভোরের নিস্তব্ধ পৃথিবীতে রোজ সে
জাগিয়ে তোলে নতুন প্রাণ ও বাঁচার আশা।