বঙ্গনিউজঃ আর্থিক খাতে আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদারের দুর্নীতিতে সহায়তাকারী বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান নির্বাহী পরিচালক মো. শাহ আলম চাকরিজীবন শেষ করে এ মাসেই অবসরে (পিআরএল) যাচ্ছেন। আগামী ৩১ জানুয়ারি তার শেষ কর্মদিবস। এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ইন্টারন্যাশনাল, পিপলস লিজিংসহ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম ও লুটপাটের তথ্য চাপা দিতে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। গত বছরের ফেব্রæয়ারিতে দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও এমডি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এমন অভিযোগ করার পর তার বিভাগ বদলি ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ওই সময় দেশের সর্বোচ্চ আদালত এ কর্মকর্তাকে কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না- এমন মন্তব্য করলেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো থেকেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে চাকরিতে বহাল তবিয়তে থেকেই চাকরিজীবনের ইতি টানতে যাচ্ছেন তিনি।
পিআরএলে যাওয়ার পর এ কর্মকর্তা বিদেশে উড়াল দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকেই। তাই পিকে হালদার থেকে টাকা উদ্ধারের স্বার্থে শাহ আলমের পাসপোর্টসহ অবসর বেনিফিট জব্দ করার দাবি তুলেছেন সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভুক্তভোগী আমানতকারীরা। পিকে হালদার ইস্যুতে চলমান মামলাগুলো নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এ পদক্ষেপ নিতে আদালতের হস্তক্ষেপও চেয়েছেন তারা। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, শাহ আলমের বিরুদ্ধে ওঠা ঘুষ-দুর্নীতির রেকর্ডভিত্তিক কোনো তথ্যপ্রমাণ না থাকায় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে তার বিরুদ্ধে আদালতের নির্দেশে গঠিত ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির তদন্ত চলমান রয়েছে।
এনআরবি গেøাবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের সাবেক এমডি পিকে হালদার নানা জালিয়াতির মাধ্যমে অন্তত চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছেন। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)। সূত্রগুলো বলছে, পিকে হালদারের এ অর্থ লোপাটে সহায়তা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর চৌধুরী ও নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম। এ ছাড়া এই অর্থ লোপাটের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের অন্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও নীরব ভ‚মিকা পালন করেন।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক এমডি রাশেদুল হক গত বছরের ২ ফেব্রæয়ারি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম অনিয়ম চাপা দিতে মাসে দুই লাখ টাকা ঘুষ নিতেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর থাকাবস্থায় এসকে সুর চৌধুরী অনিয়ম ও দুর্নীতি ম্যানেজ করতেন। একই ধরনের বক্তব্য দেন পিপলস লিজিংয়ের তৎকালীন চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দীও। তিনি বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম চাপা দিতে এ দুই কর্মকর্তাসহ অন্যদের পিপলস লিজিং থেকে সাত বছরে (২০০৯-১৫) সাড়ে ৬ কোটি টাকা ঘুষ দেওয়া হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ও পিপলস লিজিংয়ের সাবেক এমডি এবং চেয়ারম্যানের ওই জবানবন্দিতে শাহ আলমের নাম এলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি। শুধু তাকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগ থেকে সরিয়ে অন্য বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
পিপলস লিজিংয়ের ব্যক্তি ও ক্ষুদ্র আমানতকারীদের নিয়ে গঠিত কাউন্সিলের সেক্রেটারি জেনারেল রানা ঘোষ আমাদের সময়কে বলেন, উনি (শাহ আলম) চলে গেলে আমরা ব্যক্তি আমানতকারীরা কি-বা করতে পারব। যারা ব্যবস্থা নেবে তারাই চুপ মেরে (বাংলাদেশ ব্যাংকসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা) বসে আছে। এতদিনেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এখন তো তিনি চলেই যাচ্ছেন।
১৯৮৮ সালের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগদান করেন শাহ আলম। আর আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের মহাব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পান ২০১৩ সালের অক্টোবরে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে তিনি নির্বাহী পরিচালক হিসেবে পদোন্নতি পান। এর পরও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বেই ছিলেন তিনি। তার সময়কালেই অন্তত ৮-১০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বড় ধরনের দুর্নীতি হয়। এ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আমানতকারীদের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না। এ খাতে লুটপাটের তথ্য গোপন করার কারণেই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আজ নাজুক অবস্থায় পতিত হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, পিকে হালদারের লুটপাটের শিকার চারটিসহ ছয়টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৩০ হাজার ব্যক্তি আমানতকারীর পরিবার জমানো টাকা ফেরত না পেয়ে নিদারুণ কষ্টে দিন পার করছেন। অথচ শাহ আলম আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন।
সূত্রগুলো বলছে, ঘুষের টাকায় শাহ আলম বিলাসী জীবনযাপন করছেন। করেছেন তিনটি বিয়ে। তার প্রত্যেকটি পরিবার দামি বাড়ি ও ফ্ল্যাটে থাকছেন। ছেলেমেয়েরা দেশ-বিদেশে নামিদামি স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। দামি গাড়িতে চড়ছেন। কিন্তু যাদের টাকায় এ বিলাসিতা সেই আমানতকারীদের কথা কেউ ভাবছে না। তারা না খেয়ে থাকলেও কেউ খবর নিচ্ছে না। ক্ষতিগ্রস্ত আমানতকারীদের প্রশ্ন বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি করে কত টাকা পায় যে, এত ভালোভাবে তিনটি পরিবার চালাচ্ছেন। তার এ অর্থসম্পদ কীভাবে হলো, সেটি তদন্ত করলেই বেরিয়ে আসবে তিনি অনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন কি, নেননি। জানা যায়, বর্তমানে নির্বাহী পরিচালক হিসেবে তিনি বেতন পাচ্ছেন ৭৩ হাজার ৭২০ টাকা। গত বছরই তিনিসহ তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট তলব করা হলেও কী পরিমাণ অর্থ রয়েছে সেটি প্রকাশ করা হয়নি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মো. শাহ আলম আমাদের সময়কে বলেন, বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও আমানতকারীদের পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে তা ভিত্তিহীন। তবে ব্যক্তিগত জীবনযাপনের বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, শাহ আলমের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ করা হলেও এ সংক্রান্ত কোনো তথ্যপ্রমাণ কেউ-ই দিতে পারেননি। আবার তাকে গ্রেপ্তার বা তার বিরুদ্ধে কোনো মামলাও করা হয়নি। তাই প্রমাণিত অভিযোগ ছাড়া কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। তবে আমরা তার বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ ওঠার পরই ওই বিভাগের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছি।
দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান আমাদের সময়কে বলেন, সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর ও বর্তমান নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমের বিদেশযাত্রা নিয়ে আদালতের নিষেধাজ্ঞা এখনো বলবৎ আছে। তবে তাদের পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছিল কিনা সেটি বলতে পারব না। শাহ আলমের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা জানতে চাইলে বলেন, অভিযুক্ত ওই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এখনো কোনো মামলা হয়নি। তবে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অনুসন্ধান পর্যায়ে রয়েছে।
জানা যায়, বিআইএফসি, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও পিপলস লিজিংয়ের জালজালিয়াতির ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের দায়দায়িত্ব নির্ধারণে আদালতের নির্দেশে গত বছরের ২২ ফেব্রæয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর একেএম সাজেদুরকে প্রধান করে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং নামে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি একই বছরের ১ অক্টোবর বিআইএফসির আর্থিক অনিয়মের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বিএফআইসির অনিয়ম-দুর্নীতির পেছনে বাংলাদেশ ব্যাংকের যেসব বিভাগের কর্মকর্তারা জড়িত ছিলেন এবং সংশ্লিষ্ট ফাইলে যারা স্বাক্ষর করেছেন তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে শাহ আলমকেও দায়ী করা হয়েছে বলে কমিটির একাধিক সদস্য জানিয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত ওই প্রতিবেদনটি আদালতে দাখিল করা হয়নি। এ প্রতিবেদন করার আগে শাহ আলমকে কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদ করে কমিটি। এ ছাড়া ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও পিপলস লিজিংয়ের আর্থিক অনিয়ম নিয়ে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির পক্ষ এখনো তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম এ বিষয়ে আমাদের সময়কে বলেন, আদালতের নির্দেশনায় একটি কমিটি গঠন করে জড়িতদের দায়দায়িত্ব নির্ধারণে কথা বলা হয়। কিন্তু ওই প্রতিবেদন আদালতে জমা দিতে হবে কিনা সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। এ কারণে কমিটির প্রতিবেদন এখন গভর্নরের কাছে জমা রয়েছে।
বিআইএফসির আর্থিক অবস্থা খারাপ হলে তার নিচের স্তরের কর্মকর্তাদের দিক থেকে প্রতিষ্ঠানটিতে প্রশাসক নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল। তবে সেই সুপারিশ তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক শাহ আলম আটকে রেখেছিলেন। তিনি ওপরের দিকে উপস্থাপন করেননি। ফলে এতে প্রশাসক নিয়োগ করা সম্ভব হয়নি। তখন প্রশাসক নিয়োগ করলে পরে জালিয়াতির ঘটনাগুলো ঠেকানো যেত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।