বঙ্গনিউজঃ ভূমি ব্যবস্থাপনায় এসেছে আমূল পরিবর্তন। বিশেষ করে ভূমি ব্যবস্থাপনা ডিজিটালাইজড করার কারণে মানুষের ভোগান্তি ও হয়রানি অনেকটাই কমে গেছে। এখন ঘরে বসেই অনেকে ই-নামজারি করাসহ নানা ধরনের সেবা পাচ্ছেন। ভূমির দুর্নীতির সুযোগ কমাতে মাঠপর্যায়ে ভূমি কর্মকর্তাদের ‘বিবেচনামূলক ক্ষমতা’ কমানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ভূমি সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেছেন, পুরো ভূমি ব্যবস্থাপনাকে একটি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং পদ্ধতির (এসওপি) আওতায় আনা হচ্ছে। এতে ভূমি সেবাদানকারী কর্মকর্তাদের দুর্নীতির সুযোগ বহুলাংশে কমে যাবে। গত শনিবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে এফডিসি মিলনায়তনে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির আয়োজনে ‘ভূমি ব্যবস্থাপনায় জন-অংশগ্রহণ ও সুশাসন’ শীর্ষক এক ছায়া সংসদ বিতর্ক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।
ভূমি সংশ্লিষ্টরা জানান- ক্রয়, উত্তরাধিকার বা যে কোনো সূত্রে জমির মালিক হলে নতুন মালিকের নাম সরকারি খতিয়ানভুক্ত করার প্রক্রিয়াকে নামজারি বলা হয়। ভূমি জরিপকালে ভূমি মালিকের মালিকানা নিয়ে যে বিবরণ প্রস্তুত করা হয় সেটাই খতিয়ান। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নামজারির সিস্টেম ছিল একটি জটিল প্রক্রিয়া। এতদিন হয়রানি, দীর্ঘসূত্রিতা ও দুর্নীতি মাড়িয়ে করা হতো নামজারি। এসব সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ই-নামজারিকে একটি বিপ্লব বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। অনুষ্ঠানে ভূমি সচিব বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভূমি মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় ৩১টি দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নেতৃত্বে ভূমি মন্ত্রণালয় তা বাস্তবায়ন করছে। ভূমি অপরাধ আইনের খসড়া তৈরি প্রায় শেষ এবং মতামতের জন্য শিগগিরই তা উন্মুক্ত করা হবে। এ ছাড়া ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালের সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে ভূমি সচিব জানান, সরকারি নীতির কারণে ভূমিসেবা হটলাইন ১৬১২২ এখনই টোল-ফ্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। কেননা ভূমি বিষয়টি জরুরি সংকটময় সেবার অন্তর্ভুক্ত নয়। বাংলাদেশের একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের সুবিধার্থে ১৬১২২ নম্বরে ফোনযোগে খতিয়ান (পর্চা) ও জমির ম্যাপের আবেদন এবং ভূমি উন্নয়ন কর প্রদানের সুবিধার মতোই ফোনযোগে নামজারির আবেদনের সুযোগও তৈরি করা হচ্ছে। এতে ডিজিটাল ভূমিসেবা গ্রহণে স্মার্টফোন কিংবা ইন্টারনেট ব্যবহার করার প্রয়োজন নেই। এ ছাড়া জমির যেসব দলিল ইতোমধ্যে সরকারি অফিসে আছে এ পদ্ধতিতে তাও আলাদা করে আর জমা দিতে হবে না। এতে নামজারি করা আরও সহজ হবে।
ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ২০২১ সালের ডিসেম্বর নাগাদ অনলাইনে প্রক্রিয়াধীন আবেদনসহ মোট ৫৫ লাখ ৭৪ হাজার ৭৩৪টি ই-নামজারি আবেদন পেয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ৪৪ লাখ ১৪ হাজার ৩১৯টি আবেদনের। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় ২২ লাখ ই-নামজারির আবেদনের মধ্যে ১৯ লাখের নিষ্পত্তি হয়েছে। প্রতি বছর গড়ে ২২ লাখ নামজারির আবেদন করা হয়। ই-নামজারির ক্ষেত্রে ব্যক্তি আবেদনে বা এলটি নোটিস প্রাপ্তির পর সাধারণ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২৮ কার্য দিবস, প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিক হলে মহানগরীর জন্য ৯ কার্য দিবস ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ১২ কার্য দিবস এবং নির্দিষ্ট কয়েকটি জেলার বিনিয়োগবান্ধব শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের জন্য সাত দিনের মধ্যে নামজারি সেবা পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া সাধারণ ক্ষেত্রে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধারা জমির নামজারি সেবা পাচ্ছেন। ভূমি ব্যবস্থাপনায় এটাকে বিপ্লবই বলছে সবাই। জানা গেছে, ই-নামজারিসহ অন্যান্য সব ভূমিসেবার ডিজিটালাইজেশন কার্যক্রম মূলত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর একটি অংশ। ই-নামজারি কার্যক্রম ২০১৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের সাতটি উপজেলায় পাইলট আকারে শুরু হয়েছিল। ভূমিসেবা সহজ করতে ২০১৭ সালের ২৫ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত এক সভায় ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলমান উদ্যোগগুলো পর্যালোচনা করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে সারা দেশে একযোগে শতভাগ ই-নামজারি বাস্তবায়ন শুরু হয়। এখন তিনটি পার্বত্য জেলা ছাড়া উপজেলা ভূমি ও সার্কেল অফিসে এবং ইউনিয়ন ভূমি অফিসে ই-নামজারি চালু রয়েছে। মুজিব শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে জমির মালিকানা নিশ্চিত করতে নামজারির ম্যানুয়াল আবেদন গ্রহণ বন্ধ করা হয়েছে। আইসিটি বিভাগ এবং এটুআই প্রকল্পের সার্বিক সহায়তায় ভূমি সংস্কার বোর্ডের মাধ্যমে অন্যান্য ভূমিসেবা ডিজিটালাইজেশনের সঙ্গে ই-নামজারিও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনায় এমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধনে ২০২০ সালের ১৬ জুন জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘ পাবলিক সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড-২০২০ বিজয়ী উদ্যোগের নাম ঘোষণা করে। বাংলাদেশের ভূমি মন্ত্রণালয় স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিকাশ (ডেভেলপিং ট্রান্সপ্যারেন্ট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টেবল পাবলিক ইনস্টিটিউশনস) ক্যাটাগরিতে জাতিসংঘের মর্যাদাপূর্ণ ইউনাইটেড ন্যাশনস পাবলিক সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড-২০২০ ও জাতিসংঘ জনসেবা পুরস্কার ২০২০ অর্জন করে। চলতি বছরের ১৩ ডিসেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে মদিনাত জুমেইরাহ সম্মেলন কেন্দ্রে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ক বিভাগ কর্তৃক যৌথভাবে আয়োজিত ‘ইউনাইটেড ন্যাশনস পাবলিক সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পক্ষে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী এই পুরস্কার গ্রহণ করেন।