বঙ্গনিউজঃ সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে শেষ মুহূর্তে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে বন্দরনগর নারায়ণগঞ্জে। কাল সকালে শুরু হওয়া ভোট গ্রহণের ফলাফল নিজের দিকে টানতে মরিয়া প্রধান দুই মেয়র প্রার্থী। আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার মেয়র প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীর পক্ষে গতকাল শহরে হয়েছে বিশাল শোডাউন। ধরপাকড় ও হয়রানি আতঙ্কের মধ্যে থাকা স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী ও সদ্য অব্যাহতিপ্রাপ্ত বিএনপি নেতা তৈমূর আলম খন্দকারও গতকাল বন্দরে শোডাউন করে জয়ের আশা জানিয়েছেন। নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা গত মধ্যরাতে শেষ হয়েছে। তাই সকাল থেকেই মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা প্রচারণা নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। অলিগলি-রাজপথ ছিল প্রচারে মুখর। সকালে প্রধান দুই মেয়র প্রার্থী আইভী ও তৈমূর সংবাদ সম্মেলন করেন। দুপুরে নামাজের বিরতি দিয়ে করেন সমাবেশ-শোডাউন। এ ছাড়া সকালে শহরে র্যালি করেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মেয়র প্রার্থী মাওলানা মো. মাছুম বিল্লাহ। অন্য চার মেয়র প্রার্র্থীর চোখে পড়ার মতো প্রচারণা ছিল না। তবে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থীরা টানা গণসংযোগ করেছেন।
গতকাল বিকালে নারায়ণগঞ্জ শহরের ২ নম্বর রেলগেটে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ের সামনে অস্থায়ী মঞ্চ করে পথসভা অনুষ্ঠিত হয়। জেলার বিভিন্ন অংশ থেকে নেতা-কর্মীরা মিছিল নিয়ে যোগ দেন। ফলে পথসভা বিশাল জনসভায় রূপ নেয়। কর্মী-সমর্থকরা নৌকার স্লোগানে পুরো এলাকা মুখরিত করে তোলেন। প্রতীকী নৌকা, প্ল্যাকার্ড, ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে মিছিলে অংশ নেন তারা। কর্মী-সমর্থকরা নেচে-গেয়ে উল্লাস করে সানাই, ভেঁপুসহ নানা যন্ত্র বাজিয়ে আনন্দে মেতে ওঠেন। ঢাকঢোল পিটিয়ে নৌকার পক্ষে ভোট চেয়ে মিছিল থেকে লিফলেট বিতরণ করা হয়। পথসভায় বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং কেন্দ্রীয় নির্বাচন টিমের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমান, যুগ্মসাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন, আফজাল হোসেন, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী ও স্থানীয় নেতারা। এ সময় আইভী বলেন, দুঃসময়ে যখন নারায়ণগঞ্জে কেউ ছিল না, অনেকে পালিয়ে ছিলেন তখন আমি ছিলাম। এ কারণেই শেখ হাসিনা বারবার আইভীকে নৌকা দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমি আমার বাবার মতো নারায়ণগঞ্জবাসীর খেদমত করতে জীবন বাজি রেখেছি। যে কোনো সময় আমার জীবনে অনেক কিছু ঘটতে পারে। আমি আপনাদের জন্য মৃত্যুকেও বরণ করে নিতে রাজি আছি। নিজের ঘর-সংসারের দিকে তাকাইনি। এসেছি আপনাদের সেবা করতে। নিশ্চয় আপনারা আমাকে বিমুখ করবেন না। নিশ্চয় উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখবেন। পথসভায় জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, নারায়ণগঞ্জের অশান্তির বিরুদ্ধে শান্তির সপক্ষে নির্ভীকভাবে দাঁড়িয়েছেন আইভী। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন নারায়ণগঞ্জবাসী যদি আইভীকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করেন তাহলে নারায়ণগঞ্জের উন্নয়নের সব দায়িত্ব তাঁর। আবদুর রহমান বলেন, নারায়ণগঞ্জের মাটিতে ত্বকীর মতো শিশু হত্যা হয়েছে, সাত খুন হয়েছে, আইভী প্রতিজ্ঞা করেছেন ত্বকীর মতো আর কোনো কিশোর যেন হত্যার স্বীকার না হয়। আর যেন নারায়ণগঞ্জে সন্ত্রাসের বাঁশি বেজে না ওঠে। বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, সেলিনা হায়াৎ আইভী নির্বাচিত হলে এ নগর উন্নত-সমৃদ্ধ হবে- সেই ওয়াদা আপনাদের সামনে এসে করে গেলাম। তাঁর পক্ষেই সম্ভব হবে এ এলাকার উন্নয়ন।
পথসভার পর আইভীর নেতৃত্বে শোভাযাত্রা কালীবাজার, দিগুবাবুর বাজার, আমলাপাড়া, নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাব, চাষাঢ়া গোলচত্বর ঘুরে ২ নম্বর রেলগেট এলাকায় গিয়ে শেষ হয়। পথসভা ও র্যালিতে কেন্দ্রীয় নেতার মধ্যে অংশ নেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, কৃষি ও সমবায় বিষয়ক সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী, মহিলা বিষয়ক সম্পাদক মেহের আফরোজ চুমকি, কেন্দ্রীয় সদস্য এ বি এম রিয়াজুল কবির কাওছার ও মারুফা আকতার পপি, ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইসহাক আলী খান পান্না ও মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটন প্রমুখ। এ ছাড়া ছাত্রলীগ সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য, যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল, স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি নির্মল রঞ্জন গুহ ও সাধারণ সম্পাদক আফজালু রহমান বাবুর নেতৃত্বে স্ব স্ব সংগঠনের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতা-কর্মীরা মিছিলসহ গণসংযোগ করেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের কেন্দ্র সমন্বয়কদের নিয়ে সভা : নারায়ণগঞ্জের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ১৯২টি কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা মুক্তিযোদ্ধা প্রতিনিধিদের নিয়ে সভা করা হয়েছে। গতকাল জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে এ সভায় ডেপুটি কমান্ডার অ্যাডভোকেট নুরুল হুদার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে নৌকার পক্ষে আয়োজিত মিছিলে অংশ নেন মুক্তিযোদ্ধারা।
রাতে তৈমূরের হঠাৎ সংবাদ সম্মেলন : নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনের স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার গতকাল রাত ১০টায় হঠাৎ সংবাদ সম্মেলন করেছেন। এ সময় তিনি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে শঙ্কা প্রকাশ করে বিভিন্ন অভিযোগ করেন। সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসনের কাছে কোনো ন্যায়বিচার না পেয়ে এতো রাতে আপনাদের (গণমাধ্যম কর্মী) শরণাপন্ন হতে বাধ্য হচ্ছি। সেই জন্য আমি লজ্জাবোধও করছি। এছাড়া অন্য কোনো উপায়ও দেখছি না। উৎসবমুখর পরিবেশেই নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন হতে যাচ্ছিলো। প্রথম থেকেই আমরা তেমনটিই প্রত্যাশা করেছিলাম। জনগণ যেটা রায় দেবে সেটাই আমরা মেনে নিবো। কিন্তু বিভিন্ন স্থান থেকে এমন কিছু তথ্য আমার কাছে আসছে সেগুলো জানাতেই আজকে (গতকাল) দ্বিতীয়বারের মতো এই সংবাদ সম্মেলন। সাংবাদিকরা বিভিন্ন সময় আমাকে জিজ্ঞেস করেন দুটি কথা। এক. নির্বাচন কি সুষ্ঠু হবে? দুই. শেষ পর্যন্ত আপনি নির্বাচনে থাকবেন কি-না? দ্বিতীয় কথার উত্তর হলো, এখন তো আর দলে ড. কামাল হোসেন এবং শফিক রেহমান নেই। যে নেত্রীকে (খালেদা জিয়া) বলবেন নারায়ণগঞ্জে অমুক প্রার্থীকে পাস না করালে দেশের ক্ষতি হয়ে যাবে। তাই নির্বাচন থেকে আমার সরে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। আর সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে এতোদিন আমি আশাবাদি ছিলাম। কিন্তু এখন আমার শঙ্কা কাজ করছে।
এর আগে সকালে তৈমূর আলম খন্দকার সংবাদ সম্মেলন করে ধরপাকড়, হয়রানি, আতঙ্ক সৃষ্টির অভিযোগ করেন। নিজের জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ৫০ বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা দেখে এবং গত ১৮ বছরের সিটি করপোরেশনের নেতৃত্বের প্রতি মানুষের ‘ক্ষোভের কারণে’ ভোটাররা তাঁকেই নির্বাচিত করবেন। দুপুরে নিজ এলাকা মাসদাইর বাজার মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করে মুসল্লি ও স্থানীয়দের কাছে দোয়া চান তৈমূর। এ সময় তিনি বলেন, আমি নির্বাচিত হলে ট্যাক্স কমাব, হয়রানি কমাব, সিন্ডিকেট ভেঙে দেব। নগরবাসী আমার কাছে নিজ পরিবারের মতো সম্মান পাবেন। নির্বাচনে ন্যূনতম লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই উল্লেখ করে তৈমূর বলেন, সরকারের মদদ ও পৃষ্ঠপোষকতায় বাইরে থেকে অতিথিরা এসে পরিস্থিতি জটিল করছেন। সরকারি প্রার্থী নির্বাচনে একের পর আচরণবিধি লঙ্ঘন করে যাচ্ছেন। তাঁর কোনো বিচার না করে উল্টো আমাদের ধরপাকড় চালানো হচ্ছে। বিকালে বন্দর এলাকায় নির্বাচনী শোডাউন করেন তৈমূর আলম খন্দকার। তবে কোনো পরিকল্পনা না থাকলেও বন্দর উপজেলায় নির্বাচনী গণসংযোগে হাজার হাজার মানুষ তাঁকে চমকে দিয়েছে। তৈমূর তাঁর সঙ্গে কয়েকজনকে নিয়ে গণসংযোগে গিয়েছিলেন বন্দরে। সেখানে তিনি যখন উপস্থিত হন তখন হাজারো মানুষ মিছিল করে তাঁর গণসংযোগে যোগ দেয়। সেখানে উপস্থিত জেলা বিএনপি আহ্বায়ক কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম টিটু জানান, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, আওয়ামী লীগ, নাগরিক ঐক্য, সর্বস্তরের মানুষ এতে যোগ দেয়। মিছিলে প্রতীকী হাতি ও ব্যানার-ফেস্টুন দেখা গেছে। তৈমূর সেখানে বলেন, আমি জয়ী হই বা না হই আপনাদের পাশে ছিলাম, আছি, থাকব। আপনারা আমাকে চমকে দিয়েছেন এ আয়োজনে। বন্দরবাসীর নাসিকের ওপর দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও আমার প্রতি ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি এ মিছিল। আমি ভোট চাই, দোয়াও চাই। আপনারা কেন্দ্রে যাবেন এবং ফলাফল নিয়ে আসবেন এটাই আমার বিশ্বাস।
কাউন্সিলর প্রার্থীরা মুখোমুখি : নাসিকের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাত খুন মামলার প্রধান আসমি নূর হোসেনের ভাতিজা কাউন্সিলর প্রার্থী শাহ জালাল বাদল ও তার প্রতিদ্বন্দ্বী আলমগীর হোসেনের কর্মী-সমর্থকরা মুখোমুখি অবস্থানে আছেন। ৪ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী নূর হোসেনের ভাই নুরউদ্দিন মিয়া ও তার প্রতিদ্বন্দ্বী নজরুল ইসলামের কর্মী-সমর্থকরা দফায় দফায় মহড়া দিচ্ছেন। ৫ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপির সাবেক এমপি গিয়াসউদ্দিনের ছেলে সাদরিল ও তার প্রতিদ্বন্দ্বী আনিসুর রহমানের অনুসারীরা একে অন্যের বিরুদ্ধে বাগ্যুদ্ধে লিপ্ত।