বঙ্গনিউজঃ ভোটের মাঠে একে অপরের চক্ষুশূল। ক্ষণে ক্ষণে বাক্যবাণ। কৌশলে ঘায়েল আর বিষোদ্গারে কেউ কারও চেয়ে নেই পিছিয়ে। তবে সমকালের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার দু’জনই ছিলেন শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার ছায়াতলে। রাত পেরোলেই নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে তারা নামছেন ভোটযুদ্ধে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাজীব নূর ও এমএ খান মিঠু
‘সবুজ শ্যামল জনপদ, নগর গড়ি নিরাপদ’- সেলিনা হায়াৎ আইভীর নির্বাচনী স্লোগান। কথা বলার শুরুতেই তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ‘এত বছরেও শহরকে নিরাপদ করে গড়ে তুলতে পারেননি কেন?’ উত্তর দেওয়ার আগে মৃদু হাসলেন। এর পরই বলা শুরু করলেন আইভী, ‘নির্বাচনের এক দিন আগে আর কারও সমালোচনা করব না। কোনো ব্যক্তি, পরিবারের সমালোচনা করব না। তবে মানছি, নগরীকে আমি পুরোপুরি সন্ত্রাসমুক্ত করতে পারিনি। আছে কিশোর গ্যাংয়ের রাহাজানি, মাদকের ছড়াছড়ি- এসব বন্ধ করা যায়নি। এসব থেকে কাদের ছেলেপেলে বখরা পায়, আপনারাই খোঁজ নেন। তবে এটা দাবি করতে পারি, নারায়ণগঞ্জের মতো অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় সবুজায়ন করতে পেরেছি। এরই মধ্যে শেখ রাসেল পার্ক, বাবুরাইল লেক, বন্দর, সিদ্ধিরগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে গাছ লাগিয়ে সবুজায়ন করেছি। খাল ও সড়কের দু’পাশে লাগানো হয়েছে গাছ। পুকুর, খাল দখলমুক্ত করে তা পরিস্কার করায় জোর দিয়েছি। তবে এই অঞ্চলকে স্বাস্থ্যসম্মত করা কঠিন।’
আগামীকাল রোববার অনুষ্ঠেয় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনের প্রচার শুরু হওয়ার পর থেকেই প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির পদ-পদবি হারানো তৈমূর আলম খন্দকার ‘কার প্রার্থী’- ভোটের মাঠে এমন প্রশ্ন ছেড়ে দিয়ে আলোচনার রসদ জুগিয়েছেন আইভী। তবে গতকাল শুক্রবার সকালে নগরের দেওভোগ এলাকায় তার বাসভবন চুনকা কুটিরে দেওয়া সাক্ষাৎকারে একবারও ওসমানদের নাম মুখে আনেননি। এমনকি সমকালের প্রশ্নেও আপত্তি জানিয়ে বলেন, ‘আমি এসব নিয়ে আর কথা বলব না। আপনারা বরং আমার প্রতিদ্বন্দ্বী তৈমূর কাকার কথা জিজ্ঞেস করেন। উনাকে নিয়ে আলাপ করব।’
স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূরকে শক্ত প্রতিপক্ষ মনে করছেন আইভী। তার বাবা নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার মুক্তিযুদ্ধোত্তরকালের চেয়ারম্যান আলী আহাম্মদ চুনকার শিষ্য তৈমূর প্রসঙ্গে যতবার কথা বলেছেন, ততবারই আইভীর মুখ থেকে বেরিয়েছে মমতামাখা ‘তৈমূর কাকা’। তিনি বলেন, ‘আমার তৈমূর কাকা জনগণের সঙ্গে সংযোগ গড়তে পারেননি। তবে নিজে কখনও নারায়ণগঞ্জবাসীর জন্য মন্দ কিছু করেছেন বলে শুনিনি। কিন্তু যারা কাকার বাড়িঘরে হামলা করেছিল, তাদের হয়ে মাঠে নেমে ভুল করেছেন।’
‘আপনি বিভিন্ন সময় তৈমূরের ভালোবাসা ও সহযোগিতা পেয়েছেন’- এটা বলতেই আইভী বললেন, ‘নিশ্চয়ই পেয়েছি। ছোটবেলা থেকে স্নেহ পেয়েছি তার। তিনি বাবার একনিষ্ঠ শিষ্যদের একজন। শ্রমিকদের মধ্যে তাকে দিয়ে কাজ করাতেন বাবা।’
আইভীকে বলা হয়েছিল, ‘২০০৩ সালের পৌর নির্বাচনে আপনি প্রার্থী বলে তৈমূর নির্বাচন করেননি বলে মনে করে নারায়ণগঞ্জের মানুষ। তৈমূরের দাবি, নির্বাচনের পর কাউন্সিলরদের অনাস্থায় আপনার যখন অপসারিত হওয়ার অবস্থা হয়েছিল, তখন তিনি আপনাকে রক্ষা করেছিলেন।’ আইভী বলেন, ‘তৈমূর কাকা আমার জন্য নির্বাচন করেননি, এটা আমি আগে শুনিনি। ওই নির্বাচনে তার দলের প্রার্থী ছিল, তারাই তখন সরকারে ছিলেন। তবে আমাকে ষড়যন্ত্র করে ইমপিচ করার চেষ্টা করা হলে তাকে নীরব থাকতে দেখেছি। কাকা যদি দাবি করেন, তিনি আমাকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন, আমি অবশ্যই তা মেনে নেব। তবে ওই সময় তার নীরবতাই আমাকে সহযোগিতা করা। তবে আমি নিজেও অপসারণ নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলাম।’
আইভীকে বলা হয়, ‘তৈমূর আলম বলেছেন, আপনার সিন্ডিকেশনে তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছেন। বিশেষ করে আবু সুফিয়ানকে দিয়ে ঠিকাদার সিন্ডিকেট গড়েছেন। পুনর্বাসন না করে হকার উচ্ছেদ করাকে মানতে পারছেন না তৈমূর। তাই আপনার বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছেন তিনি।’ উত্তরে আইভী বললেন, ‘এগুলো খোঁড়া যুক্তি। তার নির্বাচন করতে ইচ্ছে হয়েছে, তিনি নির্বাচনে এসেছেন। আমি কোনোকালেই সিন্ডিকেট করিনি। আমার কোনো বাহিনী নেই। ঠিকাদারদের নিয়ে এখন আর সিন্ডিকেট করার সুযোগ নেই। যখন সুযোগ ছিল, তখনও তা আমি করিনি। এখন সব ই-টেন্ডার হয়। কাউকে কাজ দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। বরিশালের মামুন নামে এক ঠিকাদার ছয়টা বড় কাজ করছেন নারায়ণগঞ্জে। ঢাকার ১০ থেকে ১৫ জন ঠিকাদার নিয়মিত কাজ করছেন। খোঁজ নিয়ে দেখেন, সুফিয়ান, জাকির ওরা কয়টা কাজ পেয়েছে। তৈমূর কাকা অন্যের মুখে ঝাল খাচ্ছেন। হকারদের পুনর্বাসন করা হয়েছে নগরের চাষাঢ়া এলাকার খাজা সুপার মার্কেটের পূর্ব পাশের জমিতে। তবু শহরের ফুটপাত হকারমুক্ত করা যায়নি।’
‘হকার উচ্ছেদ করতে গিয়ে তো আপনি নিজেও হামলার শিকার হয়েছিলেন তাই না?’ আইভী বলেন, ‘ওই দিন আমি হকারদের উচ্ছেদ করতে সেখানে যাইনি। মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে ফুটপাত দিয়ে চলাফেরা করতে পারে সে জন্য হকারদের পুনর্বাসনের জন্য নামের তালিকা করে দোকান বরাদ্দ দিয়েছি। চেয়েছি তারা সেখানে যাক। তারপরও ফুটপাত হকারমুক্ত করতে পারিনি। এ জন্য প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। তা করা গেল না কেন? খোঁজ নিন আপনারা। নারায়ণগঞ্জের মানুষ জানে হকারের ব্যবসার গুড় কারা খায়।’
‘নারায়ণগঞ্জে যানজট আরও বেড়েছে মনে হচ্ছে। শহরের অন্যতম বড় সমস্যা এখন ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক। এটা বন্ধে কোনো উদ্যোগ নিয়েছিলেন কি? বাস ও ট্রাকের জন্য আলাদা টার্মিনাল নির্মাণের অগ্রগতি কতদূর?’ আইভী বলেন, ‘আসলে কিছু একটা চলতে শুরু হলে বন্ধ করা কঠিন। করোনার সময় মানবিক বিবেচনায় এসব যানকে কিছুটা ছাড় দেওয়া হয়েছিল। এগুলো বন্ধ করতে হবে। রাস্তা-ফুটপাত সিটি করপোরেশনের আর যানবাহনের অনুমতি দেওয়ার দায়িত্ব বিআরটিএর। কাজগুলো সমন্বিত হতে হবে। টার্মিনালের জন্য সম্ভাব্য জায়গা নির্ধারণ করে তা অধিগ্রহণের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলেই নির্মাণকাজ শুরু করা যাবে।’
নির্বাচনী প্রচারে হোল্ডিং ট্যাক্সকে মূল ইস্যু বানিয়েছেন তৈমূর। এ ব্যাপারে আইভীকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন, ট্যাক্স নির্ধারণ করে দেয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। সিটি করপোরেশনের ট্যাক্স বাড়ানো-কমানোর ক্ষমতা নেই। ঢাকা ও চট্টগ্রামের তুলনা করলে হবে না। ঢাকায় হোল্ডিং ট্যাক্সের সঙ্গে ওয়াসার বিল সংযুক্ত নেই বলে ঢাকার ট্যাক্স ১৭ পার্সেন্ট। নারায়ণগঞ্জে হোল্ডিং ট্যাক্সের সঙ্গে পাঁচ পার্সেন্ট ওয়াসার বিল যুক্ত রয়েছে। আদায় করা ট্যাক্সের সঙ্গে যদি উন্নয়নের তুলনা করেন, তাহলেই বিষয়টা স্পষ্ট বুঝতে পারবেন।’ আইভী আরও বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ সিটির ১ নম্বর ওয়ার্ডে ১০ বছরে ট্যাক্স আদায় হয়েছে দুই কোটি টাকার কম, উন্নয়নকাজ হয়েছে ১২০ কোটি ৯৮ লাখ টাকার। আমার বিরুদ্ধে বলার মতো আর কোনো কিছু না পেয়ে ট্যাক্স নিয়ে কথা বলছেন। খোঁজ নিয়ে দেখেন, করোনাকালে অনেকেই ট্যাক্স দিতে পারেননি। কাউকে জোর করা হয়নি। কারও কাছে ট্যাক্স বেশি মনে হলে আবেদন করতে পারেন। সিটি করপোরেশনে এ-সংক্রান্ত একটি সেকশন প্রস্তুত রয়েছে, নাগরিকের আর্থিক সংগতি বিবেচনা করে ট্যাক্স কমানোর সুযোগ রাখা হয়েছে।’
নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে কিনা- জিজ্ঞেস করা হলে আইভী বলেন, ‘আমি তাই চাই। অকারণে গ্রেপ্তার অভিযান বন্ধ করতে বলেছি। সুষ্ঠু নির্বাচনে ফল যা-ই হোক আমি মেনে নিতে রাজি।’