সাজ্জাদ মাহমুদের গল্প ‘ রুপন্তি’

Home Page » সাহিত্য » সাজ্জাদ মাহমুদের গল্প ‘ রুপন্তি’
মঙ্গলবার ● ১১ জানুয়ারী ২০২২


 রুপন্তি

বিকেলের সূর্য যখন ডুবি ডুবি ভাব,
অন্তিম পর্যায় তাকে তখন দেখেছিলাম। তার চোখে ছিলো হালকা কাজল, কপালে ছোট লাল টিপ, চুলগুলো ঘন কালো, মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল জগতের সব মায়া তার মুখে, হঠাৎ করে নাম দিয়ে দিলাম রুপন্তি।
বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলো সে, দূর থেকে দেখছিলাম আমি। কাছে যেতেই বাস চলে আসলো আর সে বাসে উঠে চলে গেলো। আমিও কিছু না ভাবে একটা বড় শ্বাস নিয়ে চলে এলাম। আর কীই বা করার ছিল তখন?
বাসায় ফিরে ভাবছিলাম কিভাবে সামনে গিয়ে কথা বলা যায়, ভাবতে ভাবতে বারান্দায় এলাম। হাতে ছিলো চায়ের কাপ, চুমুক দিচ্ছি আর রুপন্তিকে ভাবছি। তার মুখটা বারবার ভেসে ভেসে আসছিল আমার মানসপটে। তাকে কি কোথাও দেখেছি আগে? মনে হয়, হয়তো দেখেছি, কিন্তু না দেখার বেলাতেই মন বেশি সায় দিল।
.
পরের দিন সকাল সকাল বের হয়ে আসলাম। রুপন্তি কে আবার দেখতে পাবো এমন আশা রাখি নি, কিন্তু বাস থামাবার জায়গাতে সেই চিরচেনা মুখশ্রী। আজকেও সেই একই জায়গাতে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিল সে। বাস আসা মাত্রই বাসে উঠে বসলো, দেরি না করে আমিও বাসে উঠে পড়লাম। বাসে যে জায়গায় আমি বসে আছি, ঠিক তার সামনে রুপন্তি বসে আছে, কপালে টিপ, চুলগুলো খোপায় জড়ানো, চোখে কালো কাজল পরে আছে; আহা…ভাবছি তার মুখের সাজের সাথে যদি শাড়ি পরতো তাহলে কত না সুন্দরী লাগতো!
আচ্ছা সে কি বুঝতে পারছে আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি? সে আমার দিকে তাকাতেই আমি চোখ সরিয়ে নিলাম। কিছুদূর যেতেই বাস থেকে নেমে পড়লো সে, আমিও তাকে অনুসরণ করলাম..
দেখলাম একটা বাসায় ঢুকলো, আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বাসার ভিতরে চলে গেলো। ভাবছিলাম রুপন্তির বাসা হবে হয়তো, কিন্তু আমার ভাবনাকে তুচ্ছ করে দিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে আসলো সে, হাতে ছিলো কাগজের মলাটে করা নোট, বুঝতে পারলাম বান্ধবীর বাসা, রুপন্তি পড়াশুনা করে।
আরো বেশ কয়েকদিন রুপন্তিকে দেখে গেলাম। কেমন এক নেশার মত আকর্ষণ পেয়ে বসেছিল আমাকে। জানতে পারলাম, রুপন্তির বাসা আমার বাসা থেকে খুব বেশী দূরে নয়। এতদিনে সব খোঁজ খবর নেওয়া হয়ে গেছে। আমি আমার ব্যক্তিগত জীবনের দিকে একটু মন দিলাম। আমি একটা বাসায় পড়াতে যাই, ঠিক বিকাল পাঁচটার সময়, সন্ধ্যা ছয়টা বাজলে পড়ানো শেষ করে বের হচ্ছি, এমন সময় রুপন্তির সাথে দেখা! আমার দিকে তাকিয়ে একটা মিষ্টি হাসি ছুঁড়ে দিলো, ঠিক তার প্রেমে পড়ার আগমূহুর্তে! আমি সাহস করে বলে দিলাম, কেমন আছো রুপন্তি? সে আমার দিকে তাকিয়ে বললো ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন সাজু ভাই?
আমি একটু অবাক হলাম, রুপন্তি আমাকে আগে থেকে চিনতো। আমিও হয়তো তাকে দেখেছিলাম, তাই সেদিন চেনা চেনা মনে হচ্ছিল। সে তার নাম বললো আমায়। তার সাথে নানা কথা জমে উঠল। কিভাবে চিনতো এগুলা নিয়ে কথা বলতে বলতে আকাশে লালিমা শেষ হয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো। বললাম, চলো চা খাওয়া যাক। সে নির্দ্বিধায় রাজি হয়ে গেলো।বু ঝতে পারছিলাম রুপন্তিও আমাকে পছন্দ করে। আমি আমার পরিচয় দিলাম ঠিক এভাবে, একজন নিতান্ত ভালো মনের মানুষ আমি, সারাদিন ঘুমাই আর বাচ্চাদের পড়াই; এগুলো নিয়েই আমার জীবন। হঠাৎ সে আমায় বললো এখন বাসায় গিয়ে কী করবেন?
আমি বললাম তোমাকে খুঁজে বের করব।
-কিন্তু আমি তো আপনার সামনেই।
-হ্যাঁ, কিন্তু যখন চলে যাবে তখন?
রুপন্তি মিষ্টি করে হেসে দিল। সে নিজেই আমার ফেসবুক প্রোফাইল জিজ্ঞেস করলো, বলল, বাসায় গিয়ে আর কষ্ট করে খোঁজা লাগবে না।
আমি হাসলাম। কোনো কথা হল না হঠাত। আমি চুপ করে তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ, তারপর বলে উঠলাম রুপন্তি তুমি খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারো। সে মুচকি হেসে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলো।
চা শেষ করে আমি রুপন্তিকে তার বাসায় পৌঁছে দিয়ে এলাম।
ঘরে ফোন হাতে নিয়ে একটু বসতেই দেখলাম, ছোট্ট একটা ম্যাসেজ, “আমি বাসায় গিয়েছি ঠিকঠাক, আপনি চিন্তা করবেন না!”
আচমকা একটা ভাল লাগা আমার সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ল।
রুপন্তিকে আবার দেখার জন্য তখনই মন ছটফট করতে লাগল। ভাবতে লাগলাম, কাল দেখা হবে তো?

(২য় পর্ব)

বারান্দায় বসলাম এক কাপ চা হাতে নিয়ে,মোবাইল ফোনের ওপাশ থেকে রুপন্তির মেসেজ আসলো রাতের খাবার খেয়েছিলাম কিনা?
আমি মেসেজ এর উত্তরে না লিখলাম,রাতে আমি খুব কম খাই,এটা নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার ছিলো কিন্তু রুপন্তি যেনো আমার ব্যক্তিগত বিষয়ের সাথে জড়িয়ে গেলো।অনেক রাত অব্দি কথা বলার পর রুপন্তি আমায় বললো আগামিকাল নীল দীঘির পাড়ে ঠিক বিকেল ৫ টার সময় দেখা করতে হবে,আমি কিছু না বলে রাজি হয়ে গেলাম।রাতের জোৎস্না কে সাথে নিয়ে আমি রুপন্তি ঘুমিয়ে পড়লাম।সকাল বেলা ঘুম থেকে আমি দেরি করে উঠলাম,সেদিনটা রুপন্তি কে দিবো বলে আমার ব্যক্তিগত সব কাজ থেকে নিজেকে ছুটি দিলাম।অপেক্ষা করছি বিকেল ৫ টা কখন বাজবে,বারবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখছি। নীল দীঘি আমার বাসা থেকে বেশি দূরে না, আমার বারান্দা থেকে দীঘির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়, জায়গাটা খুব সুন্দর। বিকেল বেলা আমি খুব সুন্দর ভাবে নিজেকে প্রস্তুত করে বের হয়ে গেলাম।ভাবছিলাম আজ রুপন্তিকে মামার দোকানের চা খাওয়াবো, চায়ের চুমুকে ভালোবাসা সৃষ্টি হবে আর সে ভালোবাসা আমাদের পরিপূর্ণ করে দিবে।আমি দীঘির পাড়ে হাজির হয়ে গেলাম।
অপেক্ষা করছিলাম রুপন্তির জন্যে, কিছুক্ষণ পর রুপন্তি এলো, হালকা হলদে রঙের জামা পরে। রুপন্তি কে বেশ লাগছিলো, চুলগুলো ছিলো খোঁপায় জড়ানো আর চোখে কালো কাজল। আমার কাছে এসে বললো, কেমন আছেন?
আমি কোনো উত্তর না দিয়ে তার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমার মনে হচ্ছিলো রুপন্তির মন আজ ভীষণ খারাপ, জানতে চাইলাম, কী হয়েছে? রুপন্তি উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলো। ভাবছিলাম রুপন্তি হয়তো এই সুন্দর মূহুর্ত কে মন খারাপের একটা মূহুর্ত করতে চাচ্ছে না, তাই আমি চুপ করে গেলাম।
রুপন্তি আমাকে কিছু বলতে চায়, আমি এটা সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম। রুপন্তির হাতে একটা ব্যাগ ছিলো, তাতে কী আছে তা দেখার জন্য আমি ব্যাকুল হয়ে ছিলাম। রুপন্তি বললো, আপনাকে আজকে একটা জিনিস দিবো তবে তার আগে আমার একটা জিনিস চাই।
রুপন্তির নয়নতারা খুব পছন্দ, তার সুগন্ধ নাকি তার খুব ভালো লাগে।সন্ধ্যা নেমে এলো, রুপন্তি কে বললাম, চলো তোমাকে আজকে মামার দোকানের চা খাওয়াবো।
আমি আর রুপন্তি রাস্তার পাশ দিয়ে হাটছি। কিছুক্ষণ পরে রশিদ সেদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়লাম। সুন্দর করে নিজেকে সজ্জিত করে বাইরে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সুন্দর প্রতিবিম্ব তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
আলমারি থেকে রেশমি সুতায় কাজ করা সাদা পাঞ্জাবী বের করে গায়ে দিলাম। আজ নীল দীঘির পাড়ে রুপন্তির সাথে দেখা করবো কথা দিয়েছি। চশমা আর ঘড়িটা পরে বের হয়ে গেলাম। রশিদ ভাইয়ের ফুলের মেলা থেকে একগুচ্ছ নয়নতারা কিনেছিলাম কারণ রুপন্তি বলেছিলো তার নয়নতারার সুগন্ধ ভালো লাগে। ও হ্যাঁ! একটি লাল টুকটুকে গোলাপও ছিলো নয়নতারার সাথে। গোলাপ রুপন্তির হাতে দিয়ে তার ঘন কালো চুলের খোঁপায় নয়নতারা পরিয়ে দিবো ভাবছি আর হাঁটছি। কী সুন্দর না হবে সেই মুহূর্ত!
কিছুক্ষণ পরে আমি নীল দীঘির পাড়ে চলে আসলাম। বাঁশের শক্ত বেঞ্চিতে বসে রুপন্তির অপেক্ষায়। আমি কিছুক্ষণ কল্পনার জগতে হারিয়ে গেলাম, আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, রুপন্তি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে লাল শাড়ি পরে। চুল খোঁপায় জড়ানো আর কপালে ছোট লাল টিপ। আমি রুপন্তির সামনে গেলাম, গোলাপ ফুল তার হাতে দিয়ে নয়নতারাগুলো রুপন্তির খোঁপায় পরিয়ে দিলাম।সামনে এসে রুপন্তির দুহাত আলতো করে ধরে তার কানে কানে বললাম, ভালোবাসি হে প্রিয়, ভালোবাসি!
হঠাৎ আমার চোখ খুলে গেলো, কল্পনার জগত থেকে বেরিয়ে এলাম যেন। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, আকাশের লালিমা দেখা দিয়েছে, গোধূলির অন্তিম পর্যায়।
রুপন্তি আসে নি, মনে হল, রুপন্তি আর আসবে না।

সেদিন যখন রুপন্তিকে বাসায় দিয়ে আমি আমার বাসায় চলে আসলাম, মনের মাঝে একটা কথা বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিলো যে রুপন্তি কেন বলেছিলো হারিয়ে যাবার কথা। আমি সেদিন রাতে বারান্দায় বসে হাতে এক কাপ চা নিয়ে ভাবছিলাম,কিন্তু চায়ের চুমুকে আমি আর যেন প্রেম খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

মনের মধ্যে একটা অন্যরকম ভয় কাজ করতে থাকলো, মোবাইল ফোন নিয়ে রুপন্তিকে কল করলাম, কিন্তু রুপন্তি কে ফোনে পাওয়া গেল না।আমার ভয় আরও বাড়তে লাগলো, রুপন্তির কী হয়েছে?
সেদিন রাতে আর রুপন্তির সাথে কথা হল না।
রুপন্তির ফোন এলো পরদিন সকাল দশটায়, তখন আমি তড়িঘড়ি করে ফোন ধরলাম।
-হ্যালো রুপন্তি?
ওপাশে রুপন্তি নয়, অন্য কেউ ছিল। সে যা বলল, সব শুনে আমি যেন ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম।
আমি নির্বাক হয়ে রইলাম। কিছু বলতে পারছিলাম না আমি। ওপাশ থেকে ফোন কেটে গেলো।
হঠাৎ করে সব কিছু শূন্য শূন্য মনে হতে লাগল আমার। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না কোনো কিছুই।
ওপাশের জন বলল, রুপন্তি নাকি আর নেই। রুপন্তির নাকি খুবই কঠিন একটা অসুখ ছিল।
আমার ঘোর কাটল বেশ কিছুসময় পর। ভাবনা থেকে বের হয়ে এলাম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

হাল্কা বাতাস এসে আমার গায়ে লাগলো। আমি প্রতিদিন গোলাপ আর নয়নতারা নিয়ে এখানে আসি। আকাশের পানে তাকিয়ে রইলাম, চোখের কোণে জল জমে গেছে নিজের অজান্তেই। ভাবছিলাম, এখন যদি আমার পাশে রুপন্তি দাঁড়িয়ে থাকতো, আমরা একসাথে সূর্যাস্ত দেখতাম, রুপন্তি আমার হাত ধরে রাখতো আর আমি বলতাম, রুপন্তি, তোমাকে আমি….
ভাবনাগুলো আজ বড্ড বেমানান, রুপন্তিকে ভুলে থাকতে পারবো না জানি, রুপন্তি বেঁচে থাকবে আমার মাঝে সবসময়।
ভালো থেকো রুপন্তি।
ভালো থেকো।

সাজ্জাদ মাহমুদ

বাংলাদেশ সময়: ১৩:১৭:৫৩ ● ১৪৭৬ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ