বঙ্গনিউজঃ ২৮ বছরের পুরনো বিশ্ববিদ্যালয় সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ গবেষণা হলেও ২০২০ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় এ খাতে এক টাকাও ব্যয় করেনি। দ্য পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের বয়স ২৫ বছর। এই বিশ্ববিদ্যালয়েরও গবেষণা খাতে কোনো ব্যয় নেই। এভাবে দেশে সরকারি-বেসরকারি ১৫০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৫টি ২০২০ সালে গবেষণা খাতে এক টাকাও ব্যয় করেনি। ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেছে ৪৪টি বিশ্ববিদ্যালয়। একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ও বছরজুড়ে দু-চারটি প্রকাশনা ছাড়া অন্য কোনো গবেষণা করেনি।
গত বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কাছে ৪৭তম বার্ষিক প্রতিবেদন হস্তান্তর করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। ২০২০ সালের তথ্য নিয়ে তৈরি ইউজিসির বার্ষিক এই প্রতিবেদনে গবেষণার দুরবস্থার চিত্র ফুটে উঠেছে।
২০২০ সালে ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ১০৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম চালু ছিল। এর মধ্যে আটটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ২৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় এক টাকাও ব্যয় করেনি। এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেছে এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩১, পাঁচ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেছে এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৩। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ বেসরকারি।
বার্ষিক প্রতিবেদনে আরো দেখা গেছে, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় নামকাওয়াস্তে গবেষণা খাতে কিছু টাকা খরচ করে দায় সেরেছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় ৬৫ লাখ টাকা খরচ করলেও ২০২০ সালে একটি প্রকাশনাও প্রকাশ করতে পারেনি। হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় এক কোটি ২৭ লাখ টাকা ব্যয় করলেও তাদের প্রকাশনা ছিল মাত্র একটি। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় মাত্র দুটি করে প্রকাশনা প্রকাশ করেছে। তবে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ৭০ লাখ টাকা এবং রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় তিন লাখ ৪৩ হাজার টাকা ব্যয় করলেও একটি করে প্রকাশনা প্রকাশ করেছে।
২০২০ সালে গবেষণায় সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ৫৫ কোটি ২৩ লাখ টাকা। তাদের প্রকাশনার সংখ্যা ছিল ৩৭৮। আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে গবেষণায় সবেচেয়ে বেশি ব্যয় করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ছয় কোটি ৬১ লাখ টাকা। তাদের প্রকাশনার সংখ্যা ছিল ৪৪৫।
কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় অনেক পুরনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কেও ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ১২ কোটি ১৬ লাখ, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ ৯ কোটি ৩০ লাখ, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ আট কোটি ৩৭ লাখ এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ছয় কোটি ১৭ লাখ টাকা ব্যয় করেছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছয় কোটি ১৯ লাখ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় চার কোটি ৭৭ লাখ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় চার কোটি এবং বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় চার কোটি ১৫ লাখ টাকা ব্যয় করেছে।
গবেষণার বিষয়ে কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে আলোচনাক্রমে গবেষণা কার্যক্রম শুরু করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সমস্যা ও চাহিদার কথা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে জানাতে পারবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা গবেষণার মাধ্যমে চাহিদা অনুযায়ী কাজ করার পাশাপাশি উদ্ভূত সমস্যার উপায় বের করে দেবেন। আর এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণার জন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ পাবে। গবেষণার পর শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোও পণ্যের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ বাড়াতে সক্ষম হবে। এ ধরনের গবেষণা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে অর্থ পাবে, তাতে তারা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে রাষ্ট্রের বাজেটের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে পারবে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এ কে আজাদ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া উচিত গবেষণায়। সে অনুযায়ী আগে থেকেই তাদের পরিকল্পনা করা উচিত। বাজেটের জন্য বাজেট দিয়ে দিলাম, এরপর সেটা খরচ করলাম, এভাবে হলে গবেষণা বাড়বে না। এ ছাড়া এখন পিএইচডি ও পোস্ট-ডক্টরাল ডিগ্রিতে খুবই কম টাকা দেওয়া হয়। এর ফলে যাঁরা বিদেশে যেতে পারেন, তাঁরা চলে যান। আর দেশে যাঁরা থাকেন তাঁরা গবেষণায় উৎসাহিত হন না। এসব ডিগ্রির জন্য অর্থের পরিমাণ বাড়ালে গবেষণা বাড়বে। এর বাইরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও গবেষণায় অর্থ সহায়তা দিতে পারবে। এতে তারা যেমন লাভবান হবে, গবেষণাও এগিয়ে যাবে।’
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস প্রফেসর ড. মনজুর আহমদ বলেন, ‘ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় টিচিং ও রিসার্চ দুটিকেই গুরুত্ব দেয়। তাদের লক্ষ্য ঠিক করা আছে। তারা ফ্যাকাল্টিকে গবেষণায় উৎসাহিত করে। আসলে পড়ালেখার জন্য গবেষণাটা দরকার। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও গবেষণা নিয়ে তাদের লক্ষ্য ও পরিকল্পনা ঠিক করে নিতে পারে। এ জন্য কিছু ব্যবস্থাও নিতে হবে। প্রথম দিকে অর্থটা সরকারকেই দিতে হবে। তবে সেটা কাজে লাগানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে আগে থেকেই প্ল্যান করতে হবে।