আজ মননশীল গীতিকার জেব-উন- নেসা জামাল এর জন্মদিন - অধ্যাপক ড. জেবউননেছা

Home Page » সাহিত্য » আজ মননশীল গীতিকার জেব-উন- নেসা জামাল এর জন্মদিন - অধ্যাপক ড. জেবউননেছা
সোমবার ● ২৭ ডিসেম্বর ২০২১


গীতিকার জেব-উন- নেসা জামাল

“পাঁচ দশকের আয়ুটুকু এনে এত দিয়ে গেলে তুমি/ যত ভাবি তত, বেগম রোকেয়া, ঋণে বাধা পড়ি আমি/জানো কি ভগ্নি, আমরা অবলা পেষণের যাতাকলে/ দলিত মথিত হয়ে প্রতিদিনই প্রাণ দিই পলে পলে/ তুমি নাই আজ আমাদের মাঝে, প্রেরণা তবুুতো আছে / সে প্রেরণাতে যদি কাজ করে যাই- জানি অভিষ্ট কাছে/ ¯্রষ্টার কাছে এ প্রার্থনাই আজকে যুক্ত করে/ তোমার মতন রোকেয়া আসুক আমাদের ঘরে ঘরে।”
উক্ত কবিতার পংক্তিগুলো অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী যিনি গানে কবিতায়, গল্পে, প্রবন্ধে, সূচীশিল্পে নিজেকে অমর করে রেখেছেন তিনি আর কেউ নন জেবউননেসা জামাল। আজ তাঁর শুভ জন্মদিন।       তর রচিত বেগম রোকেয়া স্মরণে কবিতা থেকে উদ্ধৃত উক্ত চরণগুলো। যিনি জীবিত অবস্থায় অনুধাবন করেছিলেন বেগম রোকেয়ার মূল্য। কবিতাটি ‘দৈনিক ইনকিলাব’ পত্রিকায় ২০ ডিসেম্বর, ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। জেবউননেসা জামাল নব্বই দশকে তার জীবন সায়াহ্নে অনুভব করেছেন নারীদের অবস্থা সম্পর্কে। তিনি মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেছেন যেন বেগম রোকেয়া সবার ঘরে জন্ম নেয়। অথচ তিনি নিজেই জানতেননা যে, তিনিও একজন জীবন্ত কিংবদন্তী।
জেবউননেসা জামাল, একজন প্রতিভাময়ী উজ্জ্বল জ্যোতিস্ক, তার সম্পর্কে বলতে গেলে দিন কেটে হবে রাত। বহুমুখী প্রতিভার অধিকরী এই মেধাবী মানুষটি তার কীর্তির স্বাক্ষর রেখে গেছেন শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতিতে। জেবউননেসা একটি ইতিহাস। যে ইতিহাসের কাছে আমি নত হই। শ্রদ্ধা জানাই সালাম জানাই।
জেবউননেসা সম্পর্কে বলার পূর্বে অবশ্যই তার পরিবার সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। এ জন্য যে, তিনি একজন নির্ভীক, সৎ সমাজসেবী পরোপকারী পিতার কন্যা ছিলেন। তার পিতা মোহাম্মদ কসিরউদ্দীন তালুকদার। পারিবারিক ঐতিহ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষা-সংস্কৃতির সংমিশ্রনে লালিত জনাব কসিরউদ্দীন ছিলেন আধুনিক রুচিবোধ সম্পন্ন মানুষ। তিনি পেশায় ডাক্তার ছিলেন। তিনি লোকাল বোর্ড ও ডিষ্ট্রিক্ট বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। তিনি বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য (এম.এল.সি) ছিলেন। প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির সাথে জড়িত থাকার কারনে বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতা এইচ, এম সোহরাওয়ার্দী, নেতাজী সুভাষ বসু ও ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর আতিথ্য গ্রহণ করেন। ১৯৭১ এর ২২ মার্চ বগুড়ার ডাক্তারগণের যে মিছিল বের করেছিলেন। সে মিছিলের সামনের কাতারে ছিলেন এসোসিয়েশনের সভাপতি ড. কসিরউদ্দিন। তিনি গভীর রাত পর্যন্ত অধীর আগ্রহ ভরে সজাগ থাকতেন কখন কোন আহত যোদ্ধার চিকিৎসার জন্য তাঁর ডাক পড়ে। কিন্তু আহত মুক্তি যোদ্ধাদের সেবা তিনি বেশিদিন করতে পারেননি। ড. কসির উদ্দিনকে বগুড়ার ৬ মাইল দক্ষিণ মাঝিরার এক বধ্যভূমিতে একটি পুরনো কবরের মধ্যে ফেলে দিয়ে গুলিবিদ্ধ করে। শহর থেকে এতোটা পথ তাকে জীপে করে নেয়া হয়। স্থানীয় লোকেরা চিনে ফেলেন তাদের পরিচিত ডাক্তারকে। তারাই তাকে পুরাতন কবরে নতুন করে ঢেকে দিলেন। ২৯ মে ৭১ তিনি শহিদ হলেন। এভাবেই জেবউননেসার পিতার জীবনাবসান ঘটেছিল। সুতরাং জেবউননেসা একজন শহীদের সন্তান। দেশপ্রেমিক, জনদরদি, সমাজসেবকও নিবেদিত প্রাণ ব্যক্তিত্ব ড. কসির উদ্দিন স্ত্রী জেয়াউন নাহারকে ভালবাসতেন। অবিভক্ত বাংলার মহিলারা যখন প্রায় পর্দার অন্তরালবর্তী তখন জেয়াউন নাহার সমাজ সেবার অঙ্গনে প্রবেশ করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে জেবউননেসা রচিত ‘আমার বাবা’ প্রবন্ধ থেকে জানা যায়।
“আমার একান্ত ইচ্ছা ও অনুপ্রেরণায় সমাজসেবা হয়ে উঠল মায়ের জীবনের একটা অংশ। বহু বছর ধরে বগুড়ার জেল ভিজিটর, মিউনিসিপ্যাল কমিশনার, গার্লস গাইড কমিশনার, নারী পুনর্বাসন সমিতির ভাইস প্রেসিডেন্ট বা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যকরী পরিষদের সদস্যা হিসেবে কাজ করেছেন। জেবউননেসা জামালেরা ছিলেন পাঁচ বোন ও দুই ভাই। তাঁদের মধ্যে সকলেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। জেবউননেসা জামালের দুই ভাই এর মধ্যে ্একজন ডাক্তার, অন্য আর একজন আইনজীবী। চার বোন এম. এ ডিগ্রী প্রাপ্ত। কনিষ্ঠ বোন আঞ্জুমান আরা বেগম বাংলাদেশ বেতারে ও টেলিভিশনের পরিচিত মুখ। পূর্বেই বলেছি জেবউননেসা জামালকে নিয়ে বলতে গেলে দিন কেটে রাত হবে। তিনি ছিলেন একটি সম্ভ্রান্ত সমৃদ্ধ, সুশিক্ষিত ও রুচিশীল পরিবারের সন্তান। তার পিতা মাতা-ভাই বোনদের জীবনবৃত্তান্ত সে পরিচয়ই বহন করে। এবার আমি জেবউননেসা প্রসঙ্গেÑ
জেবউননেসা তার লিখিত স্মৃতি– ৭১ঃ প্রথম খ- লিখেছেনÑ “অনেকবার শুনেছি প্রথম সন্তান হিসেবে দুনিয়ার বুকে আসছি- এ সংবাদে কলকাতা থেকে আব্বা অনেক মহৎজীবনী গ্রন্থ মাকে পাঠাতেন। মা তখন রাজশাহীতে পিত্রালয়ে আর আব্বা হোষ্টেলে থেকে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়েন। শুনেছি আব্বার পাঠানো জীবনীগ্রন্থগুলো নিবিষ্টচিত্তে পাঠ করতেন ষোল বছরের ভাবী জননী সৈয়দা জেয়াউন নাহার।”
সত্যিই ড. কসিরউদ্দিনের সেদিনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়নি। কলকাতা থেকে তিনি যে গ্রন্থ পাঠিয়েছিলেন সে গ্রন্থ পাঠ করে সৈয়দ জেয়াউননাহার সমৃদ্ধ হয়েছিলেন। সেই সাথে সমৃদ্ধ হয়েছিলেন সৈয়দা জেয়াউন নাহারের গর্ভের সন্তান। আজকের সব্যসাচী সর্বগুণে গুণান্বিতা একটি নাম জেবউননেসা।
ধন্যবাদ ড. কসির উদ্দিন ও সৈয়দা জেয়াউন নাহারকে যারা এমন একজন গুণী মানুষকে আমাদের সমাজে উপহার দিয়ে গেছেন।
২৭ ডিসেম্বর, ১৯২৪ সাল। সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা সোনালী আম, লিচু, ও পদ্মা রুপালী ইলিশের দেশ রাজশাহী জেলার পাঠান পাড়ায় নানা বাড়িতে ফুটফুটে চাঁদমুখ একটি শিশু জন্মগ্রহণ করল। বাবা-মা নাম রাখলেন তার জেবউননেসা। যার নামের অর্থ যতটুকু জানা যায় “নারীর অলংকার”, কে জানত এই জেবউননেসা সত্যিই একদিন নারীর অলংকার হবে, যে অলংকার হবে মেধা ও মননে পরিপূর্ণ এক অসাধারণ সত্তা। তবে রাজশাহী সবুজ গ্রামে ছুটে বেড়িয়েছেন এ মাঠ থেকে সে মাঠে। পরবর্তীতে তাঁর পিতা বগুড়ায় হরতলায় বসবাস শুরু করেন। বগুড়ায় যে বাড়িতে তারা বাস করতেন সে বাসগৃহের নাম ছিল ‘হোয়াইট হাউস’।
জেবউননেসা অতি অল্প বয়সে লেখাপড়া শুরু করেন। তাঁর শিক্ষার হাতেখড়ি হয় বগুড়ার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুলের প্রভাতী শাখার শিশু শ্রেণিতে। সেখানে তিনি দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। উক্ত স্কুলেই তার প্রথম সঙ্গীতে হাতে খড়ি হয়। পরবর্তীতে তিনি তৃতীয় থেকে প্রবেশিকা (এস. এসসি) পর্যন্ত বগুড়ার ভি.এম গার্লস হাইস্কুলের দিবাশাখার ছাত্রী ছিলেন। ১৯৪১ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। পরীক্ষায় কৃতিত্বের জন্য তিনি ‘আলতাফুন্নেসা মেমোরিয়াল ট্রাষ্ট” কর্তৃক স্বর্ণপদক অর্জন করেন। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে ‘গড়ৎহরহম ংযড়ংি ঃযব ফধু” সত্যিই হাইস্কুলের এই কৃতিত্ব দেখে আর বুঝতে বাকি নেই যে ভবিষ্যতে তিনি একজন গুণী ব্যক্তি হবেন। তবে প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষার সাথে সাথে জেবউননেসা ততদিনে সঙ্গীতেও পারদর্শী হয়ে ওঠেন। প্রসঙ্গে তিনি তাঁর “আমার বাবা” নামক স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেনÑ
“…লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের গান শেখাবার জন্য সঙ্গীত শিক্ষক নিযুক্ত করতেন আব্বা। অর্ডার দিয়ে একটি সিঙ্গল হারমোনিয়ামও বানিয়ে দিয়েছিলেন আমাকে। বাড়িতে এসে গানের তালিম করতেন তারা। পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে রেয়াজ করি কিনা সেদিকে আব্বার নজর ছিল।”
এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর জেবউননেসা কলকাতার নবনির্মিত লেডি ব্রাবোন কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪৩ সালে তিনি আই, এ পরীক্ষায় বাংলায় সর্বোচ্চ নম্বর (৭৮) পেয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নগেন্দ্র স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯৪৫ সালে একই কলেজে থেকে তিনি বি, এ পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন।
১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম, এ (প্রথম পর্ব) পাশ করেন। ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম, এ (শেষ পর্ব) পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণী অর্জন করেন। তিনি “আধুনিক বাংলা কাব্যে দেশপ্রেম’ শীর্ষক গবেষণার জন্য ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমী বৃত্তি লাভ করেন। সাংসারিক ঝামেলার কারনে তার গবেষণা কার্য সমাপ্ত করতে পারেননি।
বি,এ পরীক্ষায় ্উত্তীর্ণ হবার পর ১৯৫৪ সালে চমৎকার ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী, সরকারী চাকুরিজীবী, সুশিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান সৈয়দ জামাল উদ্দিনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন জেবউননেসার পৈতৃক নিবাস বগুড়ার ‘হোয়াইট হাউসে’। অত্যন্ত জাকজমকের সঙ্গে বিবাহের অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। জেবউননেসার শ্বশুর বাড়ি বীরভূম জেলার শিউড়িতে। দাম্পত্য জীবনে জেবউননেসা সুখী একজন মানুষ ছিলেন। আর সেটি বোঝা যায় তাঁর এক সাক্ষাৎকারে। জাতীয় ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘অবদানে’ ১৯৮৭ সনে এক প্রসঙ্গে বলেনÑ
“বিবাহ পূর্ব জীবনে আব্বা ও মার যতœ ও অনুপ্রেরণা এবং বিবাহোত্তরকালে স্বামীর উৎসাহ ও সহযোগিতা আমাকে পড়া শোনা, সাহিত্য চর্চা, সঙ্গীত শিক্ষা ও সঙ্গীত রচনায় উদ্বুদ্ধ করে।”
জেবউননেসা মা হিসেবে ছিলেন একজন সফল মানুষ। সেটা প্রমাণিত হয় তাঁর ছেলেমেয়ের লেখা পড়া এবং কর্র্মক্ষেত্রের সফলতা দেখে। জীবন সংসারের শেষ পর্র্যন্ত তঁাঁর স¦ামী তাঁর পাশে থাকেননি। মাত্র ২৪ বছর সংসার জীবন ছিল তাঁর। ১৯৭৮ সালের ৩ নভেম্বর জেবউননেসা জামালের স¦ামী মৃত্যুবরণ করেন। এর পর থেকে সংসার, কর্মজীবন, সাহিত্য সংস্কৃতি আর প্রিয় সন্তানদের একাই লালন করেছেন। তিনি চার সন্তানের জননী ছিলেন। তার প্রথম সন্তান জীনাত রেহেনা, টিভি বেতারের নিয়মিত কন্ঠশিল্পী। দ্বিতীয় সন্তান সৈয়দ নিজামউদ্দিন অর্থনীতিতে এম, এ পাশ করেছেন। তৃতীয় সন্তান শামীম বারী সমাজ বিজ্ঞানে এম, এ পাশ করেছেন। তিনিও বেতার ও টিভির একজন নিয়মিত শিল্পী ছিলেন।
জেবউননেসা কর্মজীবনের শুরুতে শিক্ষক ছিলেন। দিনাজপুর সদর গার্লস স্কুলে সহ-প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে ১৯৪৮ সালে যোগদান করেন। তিন তিন বছর উক্ত স্কুলে শিক্ষকতা করেন। এই সময় তিনি মহিলা ক্যাডেট কোরের নতুন কমান্ডার হন। জেবউননেসা ১৯৫৪ সালের পরিষদ নির্বাচনে মুসলিম লীগের পক্ষে নির্বাচনে অংশগ্রহন করেন। তাঁর লেখা ‘মা’ গল্পে সেই তথ্যটি পাওয়া যায়। তিনি ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৩ পর্যন্ত চট্টগ্রাম মহিলা কলেজের অধ্যাপিকা ছিলেন। ঐ সময় তিনি আপওয়া (অষষ চধশরংঃধহ ডড়সবহ’ং অংংড়পরধঃরড়হ ) – এর সক্রিয় সদস্য ছিলেন।
১৯৬৫ এর দিকে তিনি একজন কন্ঠশিল্পী হিসেবে বাংলাদেশ বেতারে আত্মপ্রকাশ করেন- এ প্রসঙ্গে জনাব আব্দুল হাই ‘বেতার বাংলা’ পত্রিকায় তাঁর শোকবার্তায় বলেছেন।
“ষাটের দশকের মাঝামাঝি তিনি মহিলা মাহফিল, স্কুল ব্রডকাষ্ট বুনিয়াদী গনতন্ত্রের আসর, ঘরোয়া, অঙ্গনা, ঘরনী, সুখী সংসার, কলকাকলী ইত্যাদি অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছেন। ১৯৬৬ সালে তিনি রেডিওতে গীতিকার হিসেবে তিনি তালিকাভুক্ত হন।”
জেবউননেসা জামাল বাংলাদেশ টেলিভিশনের গীতিকার হিসেবে সংশ্লিষ্ট হন বাংলাদেশ টেলিভিশনের সৃষ্টিলগ্ন থেকে। ষাটের দশকের প্রথম সারির গীতিকারদের মধ্যে জেবউননেসা জামাল ছিলেন অন্যতম।
ইতিমধ্যে জেবউননেসা জামালের পারিবারিক পরিচয় (বাবা-মা), স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় জীবন, সংসার জীবন, কর্ম জীবন সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হয়েছে। এ কারণে যে তাঁর সাহিত্য জীবনকে বৃহৎ পরিসরে তুলে ধরা হবে তাই। জেবউননেসার সাহিত্য- সংস্কৃতির জীবন বর্ণাঢ্য। তিনি কবিতা লিখেছেন। গান লিখেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন, গল্প লিখেছেন, লিখেছেন রম্যরচনা, ভ্রমনকাহিনী, নিবন্ধ, স্মৃতিকথা। কোনটা রেখে কোনটা বলি। সারাজীবন নিরবে তিনি সাহিত্য সাধনা করেছেন আত্মপ্রকাশ বিমুখ এই মানুষটি।
নিতান্ত কৈশোর বয়সেই তার মধ্যে সাহিত্য প্রতিভার স্ফুলিঙ্গ দেখা যায়। তিনি তখন ৭ম শ্রেণীর ছাত্রী। তখন তাদের ক্লাস থেকে হাতে লেখা ‘সোনার তরী’ নামক একটি পত্রিকা বের হতো। সে সূত্র ধরে তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে দাদু ভাই সম্বোধনে একটি চিঠি লিখেন। ১৯৩৮ সালে লেখা জেবউননেসার চিঠির উত্তরে কালিম্পং, দর্জিলিং থেকে ৫ আষাঢ় ১৩৪৫ তারিখে কবিগুরু চিঠির উত্তর প্রদান করেন সে চিঠির শেষ অংশ ছিলো এরকমÑ
“তোমার চিঠি পড়েই জবাব দিলুম। সময় হিসেব করবার সময় মনে রেখো পথ ঘাট বর্ষার ধারায় প্রায়ই ভাঙ্গছে- যদি রাগ করতে হয় বর্ষার আকাশের পরে করো, তাতে তার বিশেষ দুঃখ হবেনা। কিন্তু আমার উপর যদি করো তবে অন্যায় বিচার হবে।
ইতি ৫ আষাঢ় ১৩৪৫
দাদু
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, এ চিঠি ছাড়াও জেবউননেসা রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখা আরো দুটি চিঠি পেয়েছিলেন। ইকবাল ভুঁইয়ার ‘রবীন্দ্রনাথের একগুচ্ছ পত্র’ থেকে জানা যায় সেখানে জেবউননেসা লিখেছেন-
“চিঠিগুলো আমারই পত্রোত্তর, প্রথমটি, দ্বিতীয় ও তৃতীয় চিঠির চেয়ে বড়ো এবং প্যাডে লেখা। অন্য দুটি অপেক্ষাকৃত ছোট ও কার্ডে লেখা।”
১৯৩৮-১৯৩৯ সালের দিকে জেবউননেসা যখন স্কুলের ছাত্রী তখন কলকাতার ‘জলছবি’ পত্রিকায় তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতাটি ছিল এরকম - “আজিকে মেঘের একী ঘনঘটা/ লুকালো কোথায় রবি আলোচ্ছটা?/ ক্ষণে ক্ষণে ডাকে মেঘ গুরু গুরু/ মোর প্রাণ কাঁপে দুরু দুরু/ বিজলী মেয়ে ঘোমটাটি খুলি/ হাসিছে আলোর চোখ দুটি তুলি/ সে হাসির ঝলকে ঝলকে/ অগ্নি ছুটিছে পলকে পলকে/ হেরিয়া ধরার এ রুদ্র ছবি/ ভীত চমকিত আমি ছোট কবি।

তাঁর লেখা সাপ্তাহিক আজাদ, নিখিল পাকিস্তান মহিলা সমিতি পত্রিকা ‘বর্ষবানী’, চট্টগ্রাম নৈশ কলেজ বার্ষিকী, মহিলা মহাবিদ্যালয় বার্ষিকী, চট্টগ্রাম মহিলা কলেজ বার্ষিকী, দৈনিক পাকিস্তানের ‘মহিলা মহল’, বাংলা একাডেমী পত্রিকা স্মৃতি, সাপ্তাহিক বেগম, দৈনিক জনকন্ঠ, সংবাদ, সাপ্তাহিক চিত্রালী, সাপ্তাহিক অনন্যা ইত্যাদি পত্র-পত্রিকায় সমসাময়িক নানা বিষয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
জেবউননেসা জামালের প্রথম গান প্রকাশিত হয় ‘মধুমিতা’ নামক একটি সাময়িকীতে ১৯৬৬ সালে। তাঁর রচিত তিনটি গানের প্রথম কলি ছিল নিমন্ত্ররুপÑ
ক. আমিতো ভ্রমর নই, কেন করি গুঞ্জন
খ. ভালোলাগায় মন ভরেছে, মন ভরেছে প্রিয়
গ. জানো জানো তুমি, কে বা সে গো কোনজন।
জেবউননেসা জামালের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা খুব বেশি নয়-গীত গ্রন্থ ৫টি, গল্প গ্রন্থ ১টি, অনুবাদ গ্রন্থ ১টি, তাঁর প্রকাশিত গীত গ্রন্থের প্রথম গ্রন্থটির নাম “আমার যতো গান’। এ গ্রন্থটি তিনি তাঁর প্রাণপ্রিয় স্বামীকে উৎসর্গ করেছেন। গ্রন্থটিতে ৬৪টি গান রয়েছে। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল আগষ্ট ১৯৭৯, ভাদ্র ১৩৮৬ এ। বাকি চারটি গীতগ্রন্থর নাম ছিল-আরজি, গান এল মোর মনে, জাদুর পেনসিল ও সাগরের তীর থেকে। প্রকাশিত ৫টি গীত গ্রন্থে চমৎকার মন্তব্য করেছেন। মন্তব্যটি ছিল এরকমÑ
বি ঃধশব ড়ঁৎ যধঃং ড়ভভ ঃড় ৎবপড়মহরংব ঃযধঃ ড়ভ ঃযব ১৩৮ ংড়হম ঈড়হঃধরহবফ রহ এধধহ ঊষড় গড়ৎব গড়হবু, রঃ রং ঢ়ড়ংংরনষব ঃযধঃ ঃযবরৎ সবষড়ফরবং ড়িঁষফ ধষসড়ংঃ যিড়ষষু নব ষড়ংঃ ভড়ৎ ঃযধঃ রং যিধঃ ধঃ ঃযব ৎড়ড়ভ ড়ভ পড়হংঁসবৎ ধহফ ঝধষব ড়ৎরবহঃবফ সঁংরপৃ নঁঃ ঃযবংব ঢ়রবপবং পধহ াবৎু বিষষ ষরাব.”
তাঁর প্রকাশিত গল্প গ্রন্থের নাম ছিল ‘হারানো দিনের গল্প’ ১৯৯৪ সনের দিকে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এই গল্প গ্রন্থটিতে তাঁর লেখা বহু পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত গল্পগুলিতে হারানো দিনের গানের মতই তিনি হারানো দিন গল্পাকারে সাজিয়েছেন। মোট ১২৮ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটিতে ১৫টি গল্প সংরক্ষিত হয়েছে। তাঁর গল্পের ভাষা ছিল সরস। গল্পের পাত্র-পাত্রীদের সংলাপে কৌতুকের স্পর্শ লক্ষ্য করা যায়। কৌতুকের স্পর্শ তাঁর গল্পগুলোর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে।
অপর আর একটি প্রকাশিত গ্রন্থের নাম। ‘বেল সাহেবের টেলিফোন আবিস্কার’ ১৯৭০ এর জুন মাসে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।
মূল ইংরেজি গ্রন্থটি জেবউননেসা জামাল সুন্দর ও সহজ ভাবে বাংলা ভাষায় রুপদান করেছেন। সে কারণে তাঁর এই গ্রন্থটি পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। গ্রন্থটি বিজ্ঞানমনস্ক এবং সাধারণ কৌতূহলী পাঠকের কাছে যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল।
জেবউননেসা জামাল যেহেতু সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন। সেহেতু স্বরলিপি সম্পর্কে তাঁর সুগভীর ধ্যান-ধারণা তাঁর গানে সর্বত্র সাফল্যের সাথে অনুসৃত হয়েছে। তাঁর গানগুলি বেতার ও টিভিতে বিভিন্ন সময়ে প্রচারিত হয়েছে এবং বহুল প্রচারিত হয়েছে। বাংলাদেশের খ্যাতনামা শিল্পীবৃন্দ তার গানে কন্ঠ দিয়েছেন। যে সকলশিল্পী তাঁর গানে কন্ঠ দিয়েছেন তাদের মধ্যেÑ আঞ্জুমান আরা বেগম, খুরশীদ আলম, মাহমুদুন্নবী, নীলুফার ইয়াসমিন, জীনাত রেহানা, নিয়াজ মোহাম্মদ, আবিদা সুলতানা, সাবিনা ইয়াসমিন, ফেরদৌসী রহমান, শামীম নার্গিস, শাকিলা জাফর, শাম্মী আখতার, লীনু বিল্লাহ, সুবীর নন্দী, বশীর আহমেদ, সামিনা চৌধুরী, ফরিদা পারভীন, শম্পা রেজা, তপন চৌধুরী, সৈয়দ আব্দুল হাদি, ফিরোজা বেগম ও আরো অনেকে।
জেবউননেসা জামালের গানের সুরারোপ করেছেনÑ সমর দাস, আজাদ রহমান, ওমর ফারুক খান, প্রণব দাস, মনসুর আলী, সুজেয় শ্যাম, দেবু ভট্টাচার্য, আলম খান, মনসুর আহমেদ প্রমুখ।
অনেক জনপ্রিয় গানের রচয়িতা ছিলেন জেবউননেসা জামাল। তাঁর সর্বাধিক গানে কন্ঠ প্রদান করেছেন কন্যা জীনাত রেহানা ও সুরকার আজাদ রহমান। জীনাত রেহানার কন্ঠে ও আজাদ রহমানের সুরে কয়েকটি জনপ্রিয় গানÑ
ক. চোখ দুটো মেলে রাখি সমস্ত দিন।
খ. সব কথা যদি রুপকথা হয়ে যায়।
গ. এক সুন্দর হৃদয়ের সুন্দর প্রেম।
ঘ. শুকতারা হয়ে এলে।
ঙ. সবাই বলে শিল্পী আমি।
চ. তোমায় আমি শুনিয়ে গেলাম।
এমন আরো অনেক জনপ্রিয় গান জীনাত রেহানা গেয়েছেন। সুর দিয়েছেন আজাদ রহমান।
জেবউননেসা জামালের গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল আবেগ ও রোমান্টিকতা। উদাহরণস্বরুপ তাঁর রচিত বহুল প্রচারিত জনপ্রিয় গানের চারটি চরণ দেখলে বোঝা যাবে তাঁর কন্যা জিনাত রেহানা পরিবেশন করেছেন-
“সাগরের তীর থেকে
মিষ্টি কিছু হাওয়া এনে
তোমার কপালে ছোঁয়াবো গো
ভাবি মনে মনে।”
তিনি তাঁর রচিত ‘সাগরের তীর থেকে’ গ্রন্থের ভুমিকায় বলেছেন-
“বাংলাদেশের গল্প-উপন্যাস কবিতার বই অহরহ প্রকাশিত হয়ে চলেছে। কিন্তু বইয়ের বাজারে গানের বইয়ের দেখা মেলেনা। দেশের মানুষ যে সঙ্গীতানুরাগী তা অস্বীকার করবেনা কেউই। কিন্তু মুদ্রিত সাহিত্যের আসরে গীতি সংকলণও যে স্থান পেতে পারে তা মেনে নিতে অনেকেই আজে দ্বিধান্বিত। অতএব ব্যক্তিগত উদ্যোগ ছাড়া গানের বই প্রকাশ একরকম সুদূর পরাহত।”
জেবউননেসা জামাল বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণ তথা দেশ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে তিনি ভারত, পাকিস্তান, সিংগাপুর, থাইল্যান্ড, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেছেন। সঙ্গীত রচনার ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতি এরুপ ১৯৮১ সনে ‘বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ’ তাকে সাহিত্য পদকে ভূষিত করে। ১৯৯৪ সালে ‘ত্রিভুজ সাহিত্যে পদকে’ ও ভূষিত হন তিনি। বাংলাদেশ সঙ্গীত রচয়িতাদের মধ্যে জেবউননেসা জামাল একটি অতি পরিচিত নাম। বাংলা গানের ঐতিহ্যের ধারা সমুন্নত রাখতে আধুনিক গীতিধর্মী সঙ্গীত রচনায় জেবউননেসা জামালের স্থান নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। বিশেষ করে বাণীর শুদ্ধতা রক্ষা করে রোমান্টিকভাবে প্রেম, আবেগ অনুভূতির প্রকাশই তাঁর রচিত গানের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। জেবউননেসা জামালের রচিত গানগুলোতে যেমন প্রেমের ছোঁয়া রয়েছে। তেমন রয়েছে কাব্যিক ধারা তাঁর রচিত। গানগুলোতে উপমা ও রুপকের ব্যবহার অসাধারন। তাঁর প্রত্যেকটি গানে নান্দনিক উপলব্দি রয়েছে। তাঁর গানগুলোকে অন্যান্য রোমান্টিক গানের চেয়ে অনায়াসে আলাদা করা যায়। প্রেম, আবেগে লেখা তার গানের বাণী জুড়ে।
জেবউননেসা জামাল খুব লাবণ্যময়ী ও সুসাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। মানুষের মাঝে সৎ গুনগুলোকে তিনি মর্যাদা দিতেন। তিনি সংসার জীবনে এক জন ¯েœহময়ী মা ছিলেন এবং ছিলেন একজন দায়িত্ব শীল গৃহকর্মী। সময়ের প্রতি ছিল তাঁর একনিষ্ঠতা। তিনি সাংসারিক সমস্ত কাজকর্ম সেরে স্বামী সন্তানদের প্রতি দায়িত্ব পালন করেও নিয়মিত সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা করেছেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর একমাত্র পুত্র নিজামউদ্দিন বলেনÑ “আমার মা কখন ও সময় নষ্ট করতেন না। গৃহকর্মের অবসরে যে টুকু বাড়তি সময় পেতেন সে সময়টুকু অবিরাম লেখালেখি চালিয়ে যেতেন। একদিন ঘুম ভেঙ্গে দেখি আলো জ্বলছে, আম্মা টেবিলে বসে, ঘাড় ঝুঁকে একটান লিখেই চলেছেন।” উদ্ধৃতিটি সৈয়দ খালেদা জাহানের ‘জেবউননেসা জামাল’ জীবনী গ্রন্থমালা থেকে নেয়া
এত প্রতিভাময়ী মানুষের স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুতে এক ধরনের নিঃসঙ্গতা অনুভব করেন। কেননা তাঁর সমস্ত কর্মকা-ে স্বামী ছিলেন বটবৃক্ষের মত। স্বামীর অনুপস্থিতি তাঁর সাহিত্যিক মনকে একেবারে নিঃস্ব করে তোলে। ১৯৯৪ সালের দিকে শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হন তিনি। ধীরে ধীরে শারীরিক বিভিন্ন জটিলতা দেখা যায়। আস্তে আস্তে জীবন থেকে অন্য জীবনে যাবার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। অবশেষে ১ এপ্রিল ১৯৯৫ সালে তাঁর পুত্র কন্যাদের মাতৃশূন্য করে বিদায় নেন।
তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে ‘ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকা’ দৈনিক আল আমিন, দৈনিক বাংলা, পূর্ণিমা পত্রিকা, বেতার বাংলা পত্রিকা, জাতীয় মহিলা সংস্থা, দি বাংলাদেশ অবজারভার, বাংলার বাণী, দৈনিক সকালের খবর, দৈনিক খবর ও দৈনিক সংবাদ পত্রিকা শোক প্রকাশ করে এবং দেশের বিশিষ্ট গুণীজনেরা তাঁর স্মরণে বিভিন্ন মূল্যায়নধর্মী বক্তব্য প্রদান করেন।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বক্তব্য ছিল ১২ এপ্রিল, ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত ‘বেতার বাংলা’ পত্রিকায় শোক সংবাদ কলমে। আমরা শোকাভিভূত। শিরোনামে আব্দুল হাইয়ের বক্তব্যটি ছিল এরকমÑ
“দেশের প্রথিতযশা গীতিকার জেবউননেসা জামাল এই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। চার দশকের ও বেশি সময় সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তিনি সক্রিয় ছিলেন। মোঘল স¤্রাট আওরঙ্গজেব দুহিতা জেবউন্নিসা ছিলেন ত্রয়ী গুণের অধিকারিনী। কবিতা লেখা, গান গাওয়া ও সুচী শিল্পর কারুকাজের জন্য তিনি ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন। বক্ষ্যমান নিবন্ধের আলোচ্য জেবউননেসার মা বাবা হয়ত মোঘল দুহিতার গুণে তাদের কন্যাও গুণান্বিত হউক এই প্রত্যাশা নিয়েই কন্যার নাম বেছে নিয়েছেন ইতিহাস থেকে হ্যাঁ, বাবা-মার প্রত্যাশা যথার্থই প্ররণ করেছেন জেবউননেসা। কন্ঠশিল্পী, চিত্রশিল্পী, সূচীশিল্পী, গদ্যশিল্পী বাণী শিল্পী, এই বহুমাত্রিক শিল্পে সার্থক পদচারণা করেছেন জেব-উন-নেসা।”
কিছু কিছু মানুষ চলে গেলে সমাজ সহিত্য সংস্কৃতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়, যা অন্য কোন কিছুর মাধ্যমে পূরণ করা যায়না। জেব-উন-নেসা তেমনই একজন মানুষ। যার বিদায়ে সঙ্গীত জগতের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতির নিয়মে জগতের সকল আর প্রাণী বিধাতার কাছে প্রত্যাবর্তন করবেই। জেব উন নেসা জামালও সেই নিয়মের ভিতরের একজন মানুষ। তিনি চলে গেছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া সুকীর্তিগুলো আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবে। বেঁচে থাকবে তাঁর স্মৃতি আর আবেগঘন, প্রেমে পরিপূর্ণ সঙ্গীতগুলো। জেবউননেসা জামাল সবার হৃদয়ে সঙ্গীতের পাখি হয়ে বিচরণ করুক এই প্রত্যাশা রইল। শুরু করেছিলাম জেরউননেসা জামালের রচিত কবিতা দিয়ে। শেষ করব তাঁরই রচিত গান দিয়েÑ
“তুমি জাগালে আমায় সূর্য যেমন
জাগায় পৃথিবীকে,
নতুন উষায়
নতুন ভাষায়
নতুন নামে ডেকে ॥

সহায়ক গ্রন্থাবলীÑ
০১. সৈয়দা খালেদা জাহান (১৯৯১), জীবনী গ্রন্থামালা, জেবউননেসা জামাল, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।
০২. ভূইয়া ইকবাল, রবীন্দ্রনাথের একগুচ্ছ পত্র ঢাকা, বাংলা একাডেমী।
০৩. জেবউননেসা জামাল: প্রবন্ধ আমার বাবা, স্মৃতি: ৭১, প্রথম খ-, বাংলা একাডেমী।
০৪. সাক্ষাৎকার, অবদান, জাতীয় ত্রৈমাসিক পত্রিকা, অক্টোবর-ডিসেম্বর ৮৭, ৪র্থ বর্ষ, ১৫ সংখ্যা।
০৫. মোহাম্মদ আব্দুল হাই: শোক সংবাদ, বেতার বাংলা নববর্ষ, ১৪০২ বৈশাখ, প্রথম পক্ষ, পৃ-১৭

অধ্যাপক ড. জেবউননেছা

লেখক ড. জেবউননেছা

অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়

বাংলাদেশ সময়: ২০:৫৩:৪১ ● ৯৪০ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ