নুরুজ্জামান শুভ, জাবি প্রতিনিধিঃ শীতের তীব্রতার মাঝেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বইছে নির্বাচনী উত্তাপ। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে চারটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।শেষ সময়ে এসে জমে উঠছে নির্বাচনী প্রচারণা।
আগামী ২৬শে ডিসেম্বর ৩য় শ্রেণীর কর্মচারী সমিতি ও ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী ইউনিয়নের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।এই দুই শ্রেণীর নির্বাচনের পোষ্টারে ছেয়ে গিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অংশে।
অন্যদিকে আগামী ২৯শে ডিসেম্বর শিক্ষক সমিতির নির্বাচন। উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের সমর্থক আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের প্যানেল থেকে সভাপতি পদে গনিত বিভাগের অধ্যাপক লায়েক সাজ্জাদ এন্দেল্লাহ এবং সাধারণ সম্পাদক পদে ইন্সটিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের অধ্যাপক মোতাহার হোসেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের উপাচার্যবিরোধী অংশটি একজোট হয়ে ‘শিক্ষক ঐক্য ফোরাম’ নামে নতুন প্যানেল ঘোষণা করেছে। ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ’ এবং ‘জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম’ মিলে এই প্যানেল।এই প্যানেল থেকে সভাপতি পদে রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মাহবুব কবির এবং সাধারণ সম্পাদক পদে অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আমজাদ হোসেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এদের মধ্যে মাহবুব কবির বিএনপিপন্থী এবং আমজাদ হোসেন আওয়ামীপন্থী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসার ক্লাবের নির্বাচন আগামী ৩০শে ডিসেম্বর।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ যারা,যাদেরকে ঘিরে এতো আয়োজন সেই শিক্ষার্থীদের জাকসু নির্বাচন বিগত ২৯ বছর হয় না। সর্বশেষ জাকসু নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯২ সালে।লম্বা সময় ধরে জাকসু নির্বাচন না হওয়ার কারণে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, শিক্ষার্থীরা নিন্দা জানিয়েছেন।
জাবির ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক
তাসবিবুল গনি নিলয় বলেন,
দীর্ঘ ২৯ বছর ধরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে হচ্ছেনা জাকসু নির্বাচন। অথচ থেমে নেই শিক্ষক সমিতি কিংবা কর্মচারী সমিতির নির্বাচন। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হলো শিক্ষার্থীরা। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো তাদের কোন প্রকার অংশগ্রহণ ছাড়াই নেয়া হচ্ছে যার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো একটি অপরিকল্পিত মাস্টারপ্ল্যান। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধির অংশগ্রহণ ছাড়াই যে সকল সিদ্ধান্ত প্রশাসন নিচ্ছে তার অধিকাংশই ছাত্র বান্ধব নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রাজনীতি বিমূখ করার যে অপপ্রয়াস তা দূর করার জন্যই জাকসু নির্বাচন অতীব গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি ছাত্রনেতার অভাবে গেস্টরুমের যেইসকল নেতারা, মতান্তরে বড়ভাইরা হলের সিট দখল, র্যাগিং এবং মারধোরের মত ঘৃণ্য কাজ পরিচালনা করে আসছে, তাদের দৌড়াত্ব অথবা নিছক অ-রাজনৈতিক কর্মকান্ড সমূলে উৎপাট করার জন্য জাকসুই হতে পারে একমাত্র বিকল্প। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় সুষ্ঠ নির্বাচনের যেই অভাব সারাদেশে বিদ্যমান তাতে জাকসু কতটা কার্যকরী ভূমিকা পালনে সক্ষম হবে।
জাবি সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক আবু সাইদ বলেন,
বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল অংশিজনের মতামত নিয়ে গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতে। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারী সবার নির্বাচন হয় প্রতিবছর কিন্তু ছাত্র সংসদ নির্বাচনে কোন উদ্যোগ নেয়া হয়না।এটার প্রধান কারণ সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে পাইবেটাইজেন করার প্রক্রিয়ায় লিপ্ত সরকার ছাত্র সমাজ এ সকল অন্যয় অনিয়মের বিরুদ্ধেই সব সময় সোচ্চার ছিল। ছাত্ররা যেন অধিকার সচেতন হয়ে সকল অনিয়ম অন্যায়ের বিরুদ্ধে না দাঁড়াতে পারে সেজন্য ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী মির্জা সোহাগ বলেন, একটি গণতান্ত্রিক দেশে অনেক বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদের নির্বাচন না হওয়া সুস্থতার লক্ষণ নয়। নির্দিষ্ট সময় পর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি, কর্মকর্তা ও কর্মচারী সমিতির নির্বাচনও নিয়মিত হয়। কিন্তু যাঁদের কেন্দ্র করে এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, সেই শিক্ষার্থীদের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই, নির্বাচিত ছাত্র সংসদ নেই। আর সিনেট পূর্ণাঙ্গ করতে হলে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিকল্প নেই।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী রুদ্র মুহাম্মদ সফিউল্লাহ বলেন,
জাকসু একটি সার্বজনীন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। এখান থেকেই জাতীয় রাজনীতির যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে উঠার কথা৷ যারা দেশ ও জাতিকে নেতৃত্ব দিতে পারবে৷ শুধু রাজনীতিই নয়, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এবং উন্নয়নের ধারায় জাকসু থাকার কথা সবসময় সক্রিয়৷কিন্তু গত ২৯ বছর ধরে শিক্ষার্থীদের জাকসু নির্বাচন হয় না। আগামীতেও হবে কিনা তারও কোন সম্ভাবনা নেই। অথচ জাবিতে বর্তমানে শিক্ষক, কর্মচারীদের নির্বাচনী উত্তাপ বিরাজমান।কিন্তু শিক্ষার্থী ও প্রশাসনের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন ও অধিকার আদায়ের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় যে প্লাটফর্ম সেই জাকসু নির্বাচন স্থবির হয়ে আছে তাই অবিলম্বে জাকসু নির্বাচন চাই।
১৯৯১ সালের জাকসুতে সাহিত্য সম্পাদক পদে বিজয়ী ও বর্তমানে জাবির নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মানস চৌধুরী বলেন,
লম্বা সময় ধরে জাকসু না হাওয়ার জন্য নিন্দা জানাই। এটার কারণ গুন্ডাবৃত্তি ও শিক্ষার্থীদের অলসতা। অবশ্য এরকম পরিস্থিতিতে নির্বাচন হলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে না বরং গুন্ডারাই জিতবে।
উল্লেখ্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের সময়ে ২০১৩ সালের নভেম্বরে জাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ নিয়েছিল এবং ২০১৪ সালের ২ জানুয়ারি জাকসু নির্বাচনের তারিখও ঘোষণা করা হয়েছিল।কিন্তু নানা কারণে সেবার জাকসু আলোর মুখ দেখে নি। বর্তমান ভিসি ফারজানা ইসলামের সময়ে ২০১৯ সালে জাকসু নির্বাচনের জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশন গঠিত হলেও পরবর্তীতে পরবর্তীতে ভিসির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন শুরু হলে জাকসু নির্বাচন আরো অন্ধকারে হারিয়ে যায়।