বঙ্গনিউজঃ সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ধর্মঘট প্রত্যাহারের আহ্বান জানালেও তাতে সাড়া দেয়নি পরিবহন মালিক শ্রমিক সংগঠনগুলো। রোববারের বৈঠক এগিয়ে এনে আজ শনিবার করতে চেয়েছিল বিআরটিএ। এ প্রস্তাবেও সাড়া দেয়নি তারা। ফলে আজ শনিবারও বাস-ট্রাক চলবে না।
বাস মালিকরা ভাড়া বৃদ্ধির দাবিতে গাড়ি বন্ধ করলেও পণ্যবাহী যানবাহনের সংগঠনগুলোর দাবি, ডিজেলের দাম কমাতে হবে। তাদের ভাষ্য, সরকার বাস ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়; কিন্তু ট্রাকের ভাড়া নির্ধারিত হয় বাজারে।
এদিকে বাসের ভাড়া ডিজেলের দামের সঙ্গে সমন্বয়ের জন্য বৈঠক ডাকা হলেও ডিজেলের বর্ধিত মূল্য প্রত্যাহারের বিষয়ে গতকাল রাত পর্যন্ত সরকার কিছু বলেনি। ডিজেলের দাম বাড়ায় ভাড়া দ্বিগুণ করার দাবি জানিয়েছেন লঞ্চ মালিকরা। ভাড়া না বাড়ালে তারাও আন্দোলনে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
পরিবহন খাতের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে ডিজেলের দাম বাড়ানো উচিত ছিল। গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামছুল হক সমকালকে বলেন, আলোচানা এখন কেন হবে? আগেই আলোচনা করা উচিত ছিল। ভাড়া কী হবে, পরিবহনের ক্ষতি কীভাবে পোষানো হবে- তা ফয়সালা করে ডিজেলের দাম বাড়ানো যেত। অধ্যাপক সামছুল হক আরও বলেন, রাত পৌনে ১০টায় ঘোষণা দিয়ে আড়াই ঘণ্টার মধ্যে ১৫ টাকা দাম বাড়িয়েছে সরকার। পৃথিবীতে কোনো দেশে এত অপেশাদার অপরিপকস্ফ কাজ হয় না। পরিবহন খাত করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকার তাদের এক টাকাও সহায়তা করেনি। অতীতেও দেখা গেছে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর সরকার স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে। এসব একপক্ষীয় সিদ্ধান্তে ধর্মঘট হয়, জিম্মি হয় জনগণ। শেষ পর্যন্ত সব ক্ষতি জনগণকেই বহন করতে হয়। এবারও ধর্মঘটের পর ভাড়া বাড়বে- যা জনগণের পকেট থেকেই যাবে। অথচ ভ্যাট-ট্যাক্স কমালে তেলের দাম বাড়াতে হতো না। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ মানুষের ঘাড়ে খরচের বোঝা চাপত না।
গতকাল নিজ বাসভবনে ব্রিফিংয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, রোববার সব অংশীজনের সঙ্গে বিআরটিএর ভাড়া পুনর্নির্ধারণ কমিটির বৈঠক হবে। আলাপ আলোচনা করে বাস্তবভিত্তিক ভাড়া নির্ধারণ করা হবে। যাতে জনগণের ওপর খরচের বাড়তি চাপ সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায়।
ধর্মঘট প্রত্যাহারে মন্ত্রীর আহ্বান নাকচ করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, বর্ধিত দামে ডিজেল কিনে বাস চালালে মালিকের লোকসান হবে। ভাড়া না বাড়ানো পর্যন্ত মালিকরা লোকসান দিয়ে বাস চালাতে রাজি নন। সমিতি ধর্মঘট ডাকেনি। সাধারণ মালিকরা বাস চালাতে নারাজ। তাদের অনুভূতির প্রতি সমিতি সমর্থন জানিয়েছে মাত্র।
বাস বন্ধ থাকায় সাধারণ মানুষের ভোগান্তির বিষয়ে খন্দকার এনায়েত বলেছেন, যাত্রীরাই মালিকদের সম্পদ। যাত্রীদের ভোগান্তিতে ফেলা তাদের উদ্দেশ্য নয়। সাধারণ মানুষকে জিম্মি করতে চান না। কিন্তু পরিস্থিতির কারণেই মালিকরা বাস বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন।
বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান রমেশ চন্দ্র ঘোষ বলেন, দূরপাল্লার বাস চলাচলে নিষেধাজ্ঞা নেই। মালিকরা বাস না ছাড়লে অ্যাসোসিয়েশন আর কী করতে পারি?
ধর্মঘট প্রত্যাহারের আহ্বানে সাড়া দিতে নারাজ ট্রাক কাভার্ডভ্যান ট্যাংকলরি মালিক শ্রমিক সমন্বয় পরিষদ। সংগঠনটির আহ্বায়ক রুস্তম আলী খান বলেন, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম আসা-যাওয়ায় কাভার্ডভ্যান, ট্রেইলারে ডিজেলের খরচ আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা বেড়েছে। করোনায় সবার ব্যবসাই খারাপ। পণ্য পরিবহনকারীরা এত টাকা বাড়তি ভাড়া দিতে রাজি নন।
ট্রাক বন্ধ থাকায় বন্দরে পণ্য জট হচ্ছে- এ বিষয়ে রুস্তম আলী বলেন, ‘তা সরকারকে ভাবতে হবে।’ পণ্যবাহী যানবাহনের আরেক সংগঠন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সদস্য সচিব তাজুল ইসলাম বলেন, ডিজেলে দাম না কমা পর্যন্ত ধর্মঘট চলবে।
তাজুল ইসলাম জানান, শুক্রবার রাত পর্যন্ত সরকারের কাছ থেকে কোনো আশ্বাস বা আলোচনার আমন্ত্রণ পাননি। পণ্যপরিবহনের নেতারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে অভিভাবক মনে করেন। তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। তিনি সড়ক পরিবহনমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে বলেছেন।
সংগঠনগুলোর কাছ থেকে বাস-ট্রাক বন্ধের ডাক আসে গত বৃহস্পতিবার। সেদিন সন্ধ্যায় পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ জানায়, শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির পর রোববার বৈঠক হবে। তাদের সিদ্ধান্ত নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা হয়েছে। কেন জনগণকে ভোগান্তিতে ফেলা ধর্মঘট এড়াতে শুক্রবারই বৈঠক করল না বিআরটিএ- এমন মন্তব্য করেছেন অনেকে।
গতকাল ধর্মঘট শুরুর পর বিআরটিএ বৈঠক এগিয়ে আনার চেষ্টা করে। সংস্থাটির চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেছিলেন, তারা চিন্তা করেছিলেন বৈঠক শনিবার করা যায় কিনা। কিন্তু পরিবহনের নেতাদের অনেকেই সেদিন ঢাকায় থাকবেন না। তাই পূর্বঘোষণা অনুযায়ী রোববারই বৈঠক হবে।
পরিবহনের একাধিক নেতা বলেন, করোনাকালে প্রায় ১৬০ দিন গণপরিবহন বন্ধ ছিল। বাসের মালিক ও শ্রমিকরা সে সময়ে পুরোপুরি বেকার ছিলেন। পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের ক্ষতি হয়েছে কলকারখানা বন্ধ থাকায়। সরকার নানা খাতকে সহায়তা দিলেও পরিবহনে দেয়নি। ব্যাংক ঋণের সুদ মওকুফের দাবি পূরণ হয়নি। উল্টো ২০১৯ সালে বাড়ানো আগাম আয়করের টাকা একসঙ্গে তিন বছরের আদায় করছে। বিআরটিএর ব্যয় বিশ্নেষণ কমিটি ২০১৯ সালে ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব করলে সরকার তা অনুমোদন করেনি। সাধারণ মালিকরা এসব কারণে ক্ষুব্ধ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই নেতারা আরও বলেন, ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধি ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়েছে। এ কারণে পরিবহন শীর্ষ নেতারা আওয়ামী লীগের পদধারী কিংবা সরকার সমর্থক হলেও ধর্মঘট প্রত্যাহার করতে পারছেন না। আবার সরাসরি ধর্মঘটেও যেতে পারছেন না।